ডেস্ক রিপোট:- ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংসতা, হতাহত ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে সরকার। নাশকতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। তারা বলছে, নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে সরকার সবসময়ই বিরোধীদের দায়ী করে আসছে। এটা তাদের পুরোনো অভ্যাস। কারফিউ ও সরকারের দমন-পীড়নের ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না বিএনপি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ও কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি দাবি করে কর্মসূচি দিতে পারছে না তারা। তবে, রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ আন্দোলন থামবে না বলে মনে করে দলটি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুখোমুখি হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
প্রশ্ন: কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মির্জা ফখরুল: ছাত্রদের আন্দোলনকে পুরোপুরি রং হ্যান্ডলিং করেছে সরকার। তাদের দায়িত্বশীলতার অভাব ও অদূরদর্শিতার কারণে আন্দোলন আরও গতি লাভ (গিয়ারআপ) করে। ২০১৮ সালে বিষয়টি (কোটা সংস্কার) সমাধান হয়ে গিয়েছিল। পরে কোর্টের রায়ের উছিলায় নতুন করে ইস্যু তৈরি করা হলো। ইস্যুটিকে গিয়ারআপ করায় রায়ের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। এরপর আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর বার্তা, হুমকি-ধমকি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাব শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তোলে। ভয় দেখিয়ে ছাত্রলীগকে তারা পৈশাচিক কায়দায় ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীকালে পুলিশের অ্যাকশন সবাই দেখেছে। সে কারণেই আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
আন্দোলনে শত শত ছাত্র ও জনতা মারা গেছে। সেটাকে আমলে না নিয়ে স্থাপনা ভাঙচুরকে তারা হাইলাইটস করছে। ভাঙচুর, হামলা আমরা কখনো সাপোর্ট করি না। সম্পত্তি নষ্ট করা কখনোই বিশ্বাস ও সমর্থন করি না। আজকে কোটার বিষয়টি সরকার যেভাবে সমাধান করেছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি মেনে নিচ্ছে না আন্দোলনকারীরা। সেই সমস্যা তো থেকেই গেল। ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা না করে যে সমস্যা তৈরি করছে, আমি মনে করি সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রেখে আসল বিষয়কে ডাইভার্ট করা হচ্ছে। সেটি হচ্ছে—এরা (সরকার) সম্পূর্ণ অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক এবং অবৈধ সরকার।
নির্বাচন ছাড়াই তারা এসেছে। সেজন্যই তারা এসব কথাবার্তা বলছে।
প্রশ্ন: আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: আন্দোলনকারী ছাত্রদের উদ্দেশে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাঙ্গাত্মক ও উস্কানিমূলক বক্তব্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের দিয়ে জোর করে সাজানো বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। সরকার নিজেই ছাত্রলীগকে আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। এমনকি লেলিয়ে দিয়েছে নিরীহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে। যে কারণে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আলোচনার পরিবেশ তৈরি না করে আরও বিদ্রুপ করতে থাকে। আন্দোলন বেগবান হতে দেখে মন্ত্রীরা বলতে থাকে, আদালতই সমাধান করবে। পরে, আদালত থেকে সমাধান আসবে বলে আশ্বাস দিতে থাকেন তারা। সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে আজ এত দূর পর্যন্ত গড়াত না। কারণ, শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছে যৌক্তিক সংস্কার।
প্রশ্ন: এই আন্দোলনে প্রাণহানি ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে কি যোগাযোগ করা হয়েছে?
মির্জা ফখরুল: আমরা যতদূর পারি আমাদের দল থেকে চেষ্টা করছি। এখন তো পুরো ঝামেলাটাই আমাদের ওপর এসে পড়েছে। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা জানেন যে, কারফিউর আগে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর পরই কিন্তু আমাদের রংপুরের নেতৃবৃন্দ আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করে খোঁজখবর নিয়েছে। এ ছাড়া, দেশের অন্যান্য জায়গায় নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে আমাদের নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রনেতারা যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রশ্ন: হামলায় আহত চিকিৎসাধীনদের দেখতে হাসপাতালে যাবেন কি না?
মির্জা ফখরুল: এখন যে সিচুয়েশন তাতে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। সরকারের দমন-পীড়নে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছি না।
প্রশ্ন: আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্থাপনায় হামলা-সংঘর্ষ-হত্যাকাণ্ড তদন্তে দলীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেবে কি বিএনপি?
মির্জা ফখরুল: না, এ ব্যাপারেও এখন আমাদের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রশ্ন: সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে সহিংসতার সঙ্গে বিএনপি জড়িত? এ বিষয়ে আপনারা বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করবেন কি না?
মির্জা ফখরুল: আমাদের ওপর সরকারের দোষ চাপানো পুরোনো অভ্যাস। এটি সম্পূর্ণ অমূলক। আমরা সহিংসতা করিনি, এটা প্রমাণে কোনো উদ্যোগের দরকার হয় না। কারণ, কারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা সবাই জানেন। আমরাও জাতির সামনে তুলে ধরেছি। সুতরাং এ বিষয়ে বিদেশিদের জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তারা (বিদেশি) সেটা জানে। তাদের কাছে সব কিছু আছে। যতটুকু আমাদের পক্ষে সম্ভব, সেটা আমরা জানাচ্ছি গোটা জাতিকে।
প্রশ্ন: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিএনপিসহ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মুক্তি দাবি করে বিএনপি কি কোনো কর্মসূচি দেবে?
মির্জা ফখরুল: এ বিষয়ে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আপনারা জানেন, আমাদের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতৃবৃন্দ বেশিরভাগই কারাগারে। কারফিউ চলমান। যারা মুক্ত আছেন তাদের সঙ্গে এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
প্রশ্ন: কারফিউ জারি, সেনা মোতায়েন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোরতার কারণে চলমান আন্দোলন সমাপ্ত হয়েছে বলে মনে করেন?
মির্জা ফখরুল: না। এভাবে আন্দোলন কখনো শেষ হয়নি। আপনি যদি অতীতের ইতিহাস দেখেন, উত্তর পেয়ে যাবেন। পাকিস্তান আমলেও বহুবার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে। পরে কিন্তু আন্দোলন আরও বেগবান হয়েছে। এবারের আন্দোলন তো একটা ‘আইওপেনার’। এবার আন্দোলনে সব সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। কারণ এখানে রুটি-রুজির ব্যাপার আছে। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আজ একদিকে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, অন্যদিকে সর্বক্ষেত্রে সরকারের চরম ব্যর্থতা। অর্থনীতিতে চরম হতাশা। দুর্নীতি দমনে নেই সফলতা। তারা নিজেরাই দুর্নীতি করে সব ফোকলা বানিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এই সরকার। সে কারণেই জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সাময়িকভাবে সেনাবাহিনী নামিয়ে, দমন-পীড়ন আর নির্যাতন-নিপীড়ন করে, হয়তো থামিয়ে দিতে পারে। এটার যদি রাজনৈতিক সমাধান না করে, তাহলে কখনো এর শেষ সমাধান হবে না। রাজনৈতিক সমাধানটা হচ্ছে—এই সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।কালবেলাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল।