মেজর জিল্লুর রহমান (অব.):- কথা হচ্ছে কোটাপ্রথার সংস্কারের দাবি নিয়ে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজপথে চলছে। কোটা শব্দটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্ক আছে বিধায় কেউ এ স্পর্শকাতর বিষয় খোলাসা করে খোলা মনে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী না। কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলও বিতর্কে জড়িয়ে জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। মনোজগতে এমনই ভাব যে কোটার বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বলা মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা। হাতেগোনা কয়েকজন পণ্ডিত বাদে এ সরলীকরণ ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়ার ভয়ে বাস্তবতা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। সংবিধানের ২৮/৪ ধারায় সুস্পষ্ট বলা আছে, কোটাপ্রথা সমাজে অসমতা, ভেদাভেদ কমানোর জন্য অনগ্রসর গোষ্ঠীকে সামনে আসার সুযোগ দেওয়া। কেবল তালিকাভুক্ত রাজাকার ছাড়া কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী নয়। আলোচনার সুবিধার্থে একটা কথা সবার জানা দরকার, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত চরম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র প্রধান নিশানা গোল্ডেন জিপিএ আর চাকরি। উদ্যোক্তা তৈরি, পরিশ্রমী হওয়া, বাস্তব কাজের শিক্ষা, চ্যালেঞ্জ গ্রহণের শিক্ষা নেই। নেতৃত্ব দেওয়ার শিক্ষার অভাব চাকরিতে দিনের পর দিন অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করছে। কোটার ওপর ভবিষ্যৎ গড়ার নির্ভরশীলতার অসুস্থ প্রতিযোগিতা যুবকদের মধ্যে মরণব্যাধি কান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কারিগরি শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। বছরে খুব বেশি হলে ১০ লাখের মতো চাকরি দেওয়ার সক্ষমতা দেশের আছে। বছরে গড়ে ৪০ লাখ শিশু জন্ম নেয়। তাই ফোকাসটা এন্টারপ্রেনার তৈরির দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। তাতে কোটা ও চাকরির ওপর চাপ কমবে বৈষম্য সংকুচিত হবে। উন্নত দেশে সরকারি চাকরিতে আগ্রহ কম, ব্যবসায় তারা বেশি আগ্রহী। কোটার মূলনীতি হলো কোটাপ্রথা কোনো পুরস্কার নয়। কোনো জাতির অনগ্রসর গোষ্ঠীকে সমাজের অন্যদের সমতায় আনার একটা সরকারি উদ্যোগ। আমাদের সংবিধানেও তাই আছে। চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্য কাউকে বঞ্চিত করে তুলনামূলক কাউকে বেশি সুযোগ করে দেওয়া কোটা নয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে কোটাপ্রথার পক্ষে জোরালো যুক্তি ছিল। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। শত্রুপক্ষ তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সহায়সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হারিয়ে ফেলে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে থাকায় পড়াশোনা পর্যন্ত করতে পারেননি। তাই তাদের অনগ্রসর গোষ্ঠী বিবেচিত করে কোটা নির্ধারণ করা হয়। কোনো মুক্তিযোদ্ধা কোনো বিশেষ সুবিধা পেতে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের মানুষকে মুক্ত করতে। তাদের যদি কোনো সুযোগসুবিধা দেওয়া যায় তা নিঃসন্দেহে সরকারের দেওয়া উচিত। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে ৫৬ ভাগ কোটা তা-ও আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনি কেন পাবে? তারা কি যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এখন চাকরির বয়স নেই। তাদের সরকারি অর্থায়নে বাড়ি, কিছু অর্থ সঞ্চয়, চিকিৎসাব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই মেধাহীন কাউকে বংশানুক্রমে সরকারি চাকরির কোটার ব্যানারে নেওয়া উচিত না। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারমান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটা গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রথম হয়েছিল। তাঁর কাছে ৩২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা দাবিদারের তালিকা আসে। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখকষ্ট লাঘবের ফরিয়াদ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দেখতে চান। কতজন, কাদের কল্যাণ করব, কোন নিয়মে করব, কত বাজেট লাগবে জানতে চান। চেয়ারম্যান অসহায় হয়ে কোনো তালিকাই প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারেননি। ১৯৮৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ একটা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করেছিলেন তাতে ভুয়াই বেশি ছিল। তখন পর্যন্ত কোনো নিরীক্ষিত বিশ্বাসযোগ্য তালিকা প্রস্তুত হয়নি। অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী শেখ হাসিনার নির্দেশনা নিয়ে জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নিয়ে যাচাই-বাছাই করে নিরীক্ষিত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ১ লাখ ৫৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করেন। ১ লাখ ৫৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম লাল মুক্তিবার্তায় স্থান পেয়েছে।
এ তালিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন সুযোগসুবিধার প্রকল্প হাতে নেন। বাড়তি সুযোগসুবিধা প্রদানের প্রকল্প হাতে নিলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা-তদবির, সাধনা, লম্পঝম্প রকেট গতি পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম হয়নি সেও চামচাগিরি করে নয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। শিশু মুক্তিযোদ্ধাও পয়দা হয়েছে সরকারের সুবিধা ভোগ করতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরির কোটা, চিকিৎসা, ভ্রমণ, হজ, অসামান্য মর্যাদার অধিকারী হওয়া, ব্যক্তিজীবনের আর্থিক নিরাপত্তা সব লোভনীয় সুযোগ এ সরকার প্রবর্তন করায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভন্ড মুক্তিযোদ্ধারাও নড়েচড়ে আদাজল খেয়ে সনদের পেছনে ছোটাছুটি করতে শুরু করে। অনেক বীরমুক্তিযোদ্ধা এর আগে সনদের জন্য কোথাও আবেদন পর্যন্ত করেননি। এখন সুযোগসুবিধা বরাদ্দের পর তারাও এগিয়ে এসেছেন বাড়তি প্রাপ্তির আশায়। এক মুক্তিযোদ্ধা পেটে অ্যাপেনডিসাইডিক অপারেশনের দাগ দেখিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সনদের পেছনে ছুটেছিলেন। তারই বন্ধু আরেক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ঘটনাটি বলেন। বেগম খালেদা জিয়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছিলেন।
কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান পর্যন্ত দিয়ে ক্ষান্ত দিলেই ভালো। কোটা বাতিলের ফলে মেধাবীরা সরকারি অফিসে আসতে সুযোগ পাবে। সচ্ছলতা আছে তাদের চাকরি দেওয়া হলে, পুরস্কৃত করা হলে অনগ্রসর গোষ্ঠী বিবেচিত হয় না। ৫৩ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়। তখনকার প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। অনেক আগের বিশেষ বিবেচনার ঘটনা অনাদিকাল কোটা অধিকারের রূপ নিয়ে দেশের স্বার্থে চলতে পারে না। তাই এখনই কোটার সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখা দরকার, সংস্কার করা দরকার। রাজনৈতিক ফায়দা গোছানোর ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা ব্যবহার করলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসব করতে হবে, যা বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের শামিল, দেশের জন্য হানিকর।
বাংলাদেশে পণ্ডিত, বোদ্ধা, অভিজ্ঞ প্রশাসনিক বিজ্ঞদের সমন্বয়ে গণশাসন সংস্কার কমিশন তিনবার গঠিত হয়। প্রথম কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাফ্ফর আহমদের (পরে মন্ত্রী ছিলেন) নেতৃত্বে, দ্বিতীয় কমিশন হয় সাবেক সচিব জনাব রশীদের নেতৃত্বে, তৃতীয় কমিশন হয় এ টি এম শামসুল হকের নেতৃত্বে। তিনটি কমিশনই জাতির বৃহৎ স্বার্থে কোটা বাতিলের জোর সুপারিশ করে। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে বাতিল হলো না কেন?
ভোটের খেলা করতে গিয়ে জাতির সর্বনাশ করা কোনোভাবেই রাজনীতিকদের উচিত হবে না। চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটাই সংরক্ষিত। মেধায় ৪৪ ভাগ, মহিলা কোটা ১০ ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ৩০ ভাগ, জেলা ১০ ভাগ, উপজাতি ৫ ভাগ, দৈহিক অক্ষম ১ ভাগ-কোটার হিসাব খুব জটিল।
কোটাধারীরা সর্বস্তরের সুবিধা নিচ্ছে। মেধায় টিকলে মেধায়, না হলে জেলায়, তা না হলে মুক্তিযোদ্ধায়, সেখানে না হলে মহিলা কোটায়, তাতে না মিললে উপজাতি, তা না হলে অক্ষম কোটায়। এতগুলো স্তরে একজন মেধাবীকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এটা কোনোভাবেই মেধার প্রতি ন্যাচারাল লয়ের প্রতি সুবিচার হতে পারে না। যাদের জন্য পদ ফাঁকা রাখা হয়, তা পূরণও হয় না। ৩৪তম বিসিএসে মেধাবীরা ৮০ পেয়ে টিকছে না, কোটাধারী ৫০ পেয়ে চাকরি পাচ্ছে। এ মেধা, ছিটকে পড়া পদ্ধতি দেশের স্বার্থে সংস্কার করা দরকার। ভেবে দেখুন কোন দুঃখে এক চাকরিপ্রার্থী সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন-৫৬% কোটা আর অলিখিত মন্ত্রী-আমলাদের জন্য চলে যায় আরও ১৫-২০%। তাহলে সাধারণ ছাত্রদের জন্য থাকে ২০%-এর মতো। কথার ছলচাতুরী বাদ দিয়ে কোটা বিষয়ের যৌক্তিক সমাধান না হলে জনগণ এর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে। চাকরির কোটা নিয়ে গান প্যারোডি করেছেন এক প্রার্থী-‘তুমি কি দেখেছ কভু মেধার পরাজয়?’ কোটার পক্ষের লোকদের যুক্তিগুলো শুনলে হাসিও পায় আবার ব্যথিত হই। যেহেতু সংবিধানে কোটার নির্দেশনা আছে তাই সর্বোচ্চ সীমা ১০ ভাগে আনা দরকার। এতিম, অক্ষম, প্রতিবন্ধী, অনগ্রসরদের বিবেচনা করা যেতে পারে। মহিলা, পাহাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা সব স্পর্শকাতর, সরকারের দুর্বলতা আছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। প্রাক্তন ল মিনিস্টার শফিক আহমেদ জেলা কোটা তুলে দেওয়ার কথা একসময় বলেছিলেন। সব কোটা বাদ দিয়ে শুধু অনগ্রসর-অক্ষমদের কোটা থাকা উচিত। এত উন্নয়ন স্মার্ট আত্মনির্ভরশীল দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দেওয়া উচিত। একই পরিবার একবারের বেশি কোটা সুবিধা নিতে পারবে না। সচ্ছল পরিবার কোটা সুবিধা নিতে পারবে না। ভারতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ উঁচু-নিচু পাহাড়-জঙ্গল, ভাষা, শিক্ষার অগ্রসর-অনগ্রসর এত বেশি প্রকট যা পৃথিবীর আর কথাও নেই। সেই ভারতেও কোটা আছে আর তা নিয়ে সুতর্ক-কুতর্ক চূড়ান্ত পর্যায় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সরকারের সব শ্রেণিবৈষম্য লাঘবের যুক্তি জাতিগত ক্ষোভ সৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও আদালত রায় দিয়েছেন merit is the main principle. kuota is the deviation. Deviation can not exceed main principle. ভারত এখন আদালতের রায় অনুসরণ করছে। একবার কাজী রকিবউদ্দীন বলেছিলেন, গবেষণা করেছি, কোটার প্রার্থীদের এমন একটা শতকরা হিসাবে আনা উচিত, যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজনও কোটার জোরে চাকরি না পায় ও কোটা পদ শূন্য না থাকে। এমন শতকরা হিসাবে আনা উচিত যেন কোটা প্রার্থীদেরও প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব নিয়ে পরীক্ষায় অ্যাপিয়ার করতে হয় এবং তাদের মেধা নিয়ে কেউ কটাক্ষ না করতে পারে। চাটুকারির কারণেই মেধাবীরা পাড়ি জমাচ্ছে। মেধাশূন্য হলে এ দেশ একদিন জঙ্গলে পরিণত হবে। কোটা সংস্কার করুন। সবচেয়ে জরুরি হলো পদ ফাঁকা না রেখে তা মেধাবী দিয়ে পূরণ করা।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Zillu65@hotmail.com