চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রীকে কিনে দেন ৫ জাহাজ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪
  • ৯৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ১৯৮৯ সালের ১০ই জানুয়ারি পুলিশে উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগ দেয়া এই কর্মকর্তা এখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম)। এরমধ্যে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়িসহ কি নেই তার ধন ভাণ্ডারে। শুধু নিজের নয়, স্ত্রীর জন্য কিনেছেন অঢেল সম্পদ। এরমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিছু অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি। যেখানে স্ত্রী সায়রা বেগমকে ৫টি জাহাজও (বার্জ) কিনে দেয়ার তথ্য উঠে এসেছে। দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
জানা যায়, পুলিশে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের ৮টি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা কামরুল হাসান। মূলত ওই সময়েই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে ওঠেন কামরুল। এরমধ্যে নিজের ও স্ত্রীর নামে করা ১৯ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে।

দুদকের অনুসন্ধানে কামরুল হাসানের ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি থাকার তথ্য উঠে এসেছে।

এ ছাড়া একই সময়ে তার মোট ৭০ লাখ ২৮ হাজার ২৪১ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকার। উক্ত সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকা। এক্ষেত্রে তার অর্জিত সম্পদের চেয়ে তার বৈধ আয়ের উৎস ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকা কম।

এদিকে দৃশ্যত কোনো আয় না থাকলেও কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগমের ২ কোটি ৫৩ হাজার ২৪০ টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সায়মা বেগমের আছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ। এ ছাড়া একই সময়ে তার মোট ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৫ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকা। অর্থাৎ তার নামে ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য রেকর্ডপত্রদৃষ্টে পাওয়া যায়।

দুদক সূত্রে জানা যায়, সিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুল হাসানের চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকায় ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টের অষ্টমতলায় সি-৭ নামে ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১৩৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিং রয়েছে।

সোয়া সাত লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ও মাত্র ২৫ হাজার টাকায় পার্কিং স্পেস কিনেছেন আয়কর নথিতে দাবি করলেও খুলশীতে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য তিন কোটি টাকার বেশি।
চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম নাসিরাবাদে সাত শতক জমির উপর চারতলাবিশিষ্ট বাড়ি করেছেন কামরুল হাসান। জমিসহ এই ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ দেখালেও নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক ভূমিই এক কোটি টাকার বেশি মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। সেই হিসাবে ভূমি ও ভবনের বাজারমূল্য কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা।

ঢাকার সাভারে ১০৭ শতক জায়গার উপর সাভার সিটি সেন্টার নামে ১২ তলা ভবনের চারজন অংশীদারের একজন এডিসি কামরুল। সেখানে তিনি কাগজ-কলমে সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ ভবনের বেজমেন্টে ৯০টি, প্রথমতলায় ১৪০টি, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি, তৃতীয়তলায় ৮৯টি ও চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান এবং ৫ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠতলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাজারমূল্যে এ সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি। এদিকে সাভার সিটি টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনেরও অংশীদার কামরুল। সেখানে ৫৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের উত্তর হালিশহর, নাসিরাবাদ, চান্দগাঁও এলাকা শতাধিক ফ্ল্যাট ও দোকান রয়েছে কামরুলের। চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাভারে ১৫৪ শতক জমি ও দুটি বাড়ি রয়েছে তার। পাশাপাশি কামরুলের ব্যাংকে ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বন্ড ও এফডিআর থাকার তথ্য উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

জানা যায়, কামরুল হাসান স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে সওদাগর নেভিগেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছেন। এটির অফিস নগরের আগ্রাবাদের পোর্টল্যান্ড সাত্তার টাওয়ারের ৪র্থ তলায়। ৫টি ছোট জাহাজের এক তৃতীয়াংশের মালিক এই সওদাগর নেভিগেশন। এদের মধ্যে চারটির নাম জানা গেছে। সেগুলো হলো এম.ভি প্যাসিফিক রাইডার, এম.ভি. পানামা ফরেস্ট-০১, এম.ভি. রাইসা তারাননুম, বার্জ আল বাইয়েত। এই জাহাজগুলোতে কাগজে কলমে সায়মার ইনভেস্ট দেখানো হয়েছে দেড় কোটি টাকা। তবে বাস্তবে এটি ৩ থেকে চারগুণ বেশি বলে জানা গেছে।

জানা যায়, কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মার চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে ৪০ শতক নাল জমি রয়েছে। যেগুলোর ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তবে বর্তমান বাজারে সেই জমির মূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে তার নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে।

অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে এডিসি কামরুলকে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এদিকে দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসান এবং তার স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গত সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুননেছার আদালত এই আদেশ দেন।

এই বিষয়ে দুদকের আইনজীবী কাজী সানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসানের ৯ কোটি ৭৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪ টাকার এবং তার স্ত্রী সায়মা বেগমের ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস মেলেনি। গত ১৩ই মে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে দুদক কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার প্রেক্ষিতে কমিশন ওই কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন দাখিলের অনুমতি দেয়। এরমধ্যে গত ৭ই জুলাই দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত-১ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেন আদালতের কাছে পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সম্পদ ক্রোকের আবেদন করলে আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন।

এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের অন্তত আরও ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার পাশাপাশি থানার ওসিসহ একাধিক উপ-পরিদর্শক। এদের বিরুদ্ধেও শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

দুদকের কালো তালিকায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী পরিচালক (এএসপি) মো. আবুল হাশেম, চট্টগ্রামের আনোয়ারা সার্কেলের সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার মো. মফিজ উদ্দিন, পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার মায়নুর রহমান, সিএমপি’র এডিসি (ক্রাইম) কামরুল হাসান, সহকারী পুলিশ কমিশনার এ বি এম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, ডিবি পুলিশের ওসি মো. আব্দুর রহমান, বন্দর থানার সাবেক ওসি মঈনুল হোসেন, কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি ও বর্তমানে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির, চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি খাইরুল ইসলাম, চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি তদন্ত মো. মনিবুর রহমান।

এ ছাড়াও রয়েছেন বাঁশখালী থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ, পাহাড়তলী থানার সাবেক ওসি রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া, সন্দ্বীপ থানার সাবেক ওসি মুহাম্মদ সামছুল ইসলাম, বোয়ালখালী থানার সাবেক ওসি মো. সাইরুল ইসলাম, কর্ণফুলী ও নগরীর আকবরশাহ থানার সাবেক ওসি মুহাম্মদ আলমগীর, সাবেক ওসি আনোয়ার হোসেন, আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী, লোহাগাড়া থানার সাবেক ওসি মো. শাহজাহান, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোহাম্মদ শেখ রাসেল, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মীর নজরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহ আলম, সাবেক ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম চৌধুরী, রাঙ্গুনিয়া থানার উপ-পরিদর্শক সুমন কুমার দে। এদের মধ্যে মীর নজরুল ইসলাম, শাহ আলম, আবুল কাশেম চৌধুরী, এ বি এম সাহাদাৎ হোসেন মজুমদার, সুমন কুমার দে, আবুল হাশেম, প্রদীপ কুমার দাশ, রেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী, মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইতিমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions