ডেস্ক রির্পোট:- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলা বছরের পর বছর ঝুলছে। নানা কারণে সময়মতো নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব মামলা। এ কারণে দুর্নীতিতে জড়িতদের সাজা হচ্ছে না খুব একটা। সময়মতো সাক্ষী, প্রমাণ ও সক্ষমতার অভাবে অনেক মামলার কাজ শেষ করতে পারে না সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টদের মতে, পুরনো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে নতুন আসা অভিযোগ অনুসন্ধানেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তবে দুদক মনে করছে, আগের চেয়ে বর্তমানে কাজের গতি বেড়েছে। সে সঙ্গে মামলা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার ব্যাপারেও সংস্থাটি বেশ তৎপর। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত দুই মাসে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ কয়েকজন এনবিআর কর্মকর্তার অনুসন্ধান দ্রুততার সঙ্গে চলছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তদন্ত শেষে চার্জশিটও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেয়া হবে। অবশ্য দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক বলেছেন, কারও বিষয়ে তাড়াহুড়ো করবে না কমিশন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুদকের দায়ের করা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে ৩ হাজার ৩৪৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৯১৯টির বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এবং হাইকোর্টের আদেশে ৪২৯টি মামলা বিচার কাজ স্থগিত আছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে ৭৩২টি রিট, ৯২৭টি ফৌজদারি বিবিধ মামলা, ১ হাজার ২২৩টি ক্রিমিনাল আপিল ও ৬৮১টি ফৌজদারি রিভিশন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০২১ সালে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতি দমনে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়। আইন ও বিধি মোতাবেক দুর্নীতিবাজদের ধরার বিষয়ে জোর দেয়ার কথা থাকলেও তার দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটেনি। এমনকি অনুসন্ধান ও তদন্তে ধীর গতির ফলে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে দুর্র্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে একঝাঁক নতুন কর্মী নিয়োগও দেয়া হয়। সে সঙ্গে নতুন করে ১৪টি নতুন সমন্বিত কার্যালয় চালু করে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ৪০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ১১৪ জন সহকারী পরিচালক এবং ১৩৭ জন উপ-সহকারী পরিচালক। এ ছাড়া ১০৯ জন কনস্টেবল, আটজন আদালত পরিদর্শক ও ১৪ জন গাড়িচালক নিয়োগ দেয়া হয়। ওই বছর আরও ১৩২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি হয়।
২০২৩ সাল শেষে দেখা গেল দুদকের দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড কমেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরও সফলতা না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক থেকে তখন বলা হয়েছিল, এত তাড়াতাড়ি সক্ষমতার হিসাব নেয়া যায় না। দুদকের গত ছয় বছরের দুর্নীতি দমন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে দুদক। একই বছর ৪০৪টি মামলা এবং ৩৬৩টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। যদিও চলতি বছরের মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী মামলা ও অভিযোগপত্রের সংখ্যা হালনাগাদ হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মামলা দায়ের হয়েছে ৯০টি আর অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে ৭৭টি। মামলায় আসামির সংখ্যা ২১২ আর অভিযোগাপত্রে আসামির সংখ্যা ১১৮ জন।
এর আগের বছর ২০২২ সালে ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছিল দুদক। ওই বছর ৪০৬টি মামলা ও ২২৪টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। তার আগের বছর ২০২১ সালে ৮৯১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছর ৩৪৭টি মামলা এবং ২৬০টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০২০ সালে ৯৪৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। মামলা করা হয় ৩৪৮টি এবং ২২৮টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
২০১৯ সালে ১ হাজার ৭১০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিয়েছিল দুদক। একই বছর ৩৬৩টি মামলা এবং ২৬৭টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর আগের বছর ২০১৮ সালে ১ হাজার ২৬৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছর ২১৬টি মামলা এবং ২৩৬টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
দুদকের দায়ের করা মামলাগুলোর রায়ে সাফল্যের ক্ষেত্রেও জনবল বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা যায়নি। দেখা গেছে, ২০২৩ সালের রায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে দুদকের মামলায় ৬৭ শতাংশ এবং আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মামলায় ১৬ শতাংশ সাজা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে দুদকের মামলায় ৬৪ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৩৬ শতাংশ, ২০২১ সালে দুদকের মামলায় ৬০ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৩০ শতাংশ সাজা হয়। ২০২০ সালে কমিশনের মামলায় ৭২ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৪৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে দুদকের মামলায় ৬৩ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলয় ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালে দুদকের মামলায় ৬৩ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৫০ শতাংশ সাজা হয়।
রাজধানীর সেগুনবাগিচাসহ আটটি বিভাগীয় ও ৩৬টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ জমা দেয়া যায়। ২০২৩ সালে দুদকে দুর্নীতি সংক্রান্ত মোট ১৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও আগের বছর ২০২২ সালে আরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল। ওই বছর ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের মহামারির সময় ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৭৬৯টি অভিযোগ, ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ, ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ এবং ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ৬০৬টি জমা পড়ে। জমা পড়া অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানাধীন অভিযোগ ছাড়াও প্রতিবছর বেশকিছু অভিযোগ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে পাঠায় দুদক। যদিও এসব সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। একাধিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সরকারি দপ্তরগুলো আমাদের দেয়া সুপারিশগুলো আমলে নেয় না।
নিজস্ব প্রসিকিউটর নেই দুদকের: গত নভেম্বরে ১৯ বছর শেষে বিশে পা রেখেছে দুদক। কিন্তু এখনো আদালতে মামলা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেই নিজস্ব প্রসিকিউটর। তবে লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন উইং রয়েছে। অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া প্রসিকিউটর দিয়েই বিচার কাজ পরিচালনা করা হয়। দুদক আইনে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকার কথা বলা হলেও এখনো বিধিই তৈরি করতে পারেনি দুদক।
আইনের ৩৩ ধারায় বলা আছে, কমিশনের তদন্ত কাজের জন্য বিশেষ জজ আদালতে বিচারযোগ্য মামলা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকবে। ওই প্রসিকিউশনের নিয়োগ ও চাকরি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এই ধারায় নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটররা পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে গণ্য হবেন। অথচ কমিশন গঠনের ১৯ বছর পার হলেও দুদকের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়নি। সরকারি দলের আইনজীবীদের দিয়ে মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকার দুদককে সব ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু কমিশন এ-সংক্রান্ত একটি বিধিই প্রস্তুত করতে পারেনি।
এদিকে দুদকের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে কিছু কাজ বেড়েছে। আমরা কিছু কাজ আগাচ্ছি। আগে অনেকদিন তদন্ত হতো। এখন আইনের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করার চেষ্টা করছি। তবে আমাদের অনুসন্ধান খুব বেশি। এখন প্রায় আড়াই হাজার অনুসন্ধান চলমান। এত ম্যানপাওয়ার নেই যে, আমরা ৪৫ দিনের মধ্যে শেষ করতে পারবো। আমরা চেষ্টা করছি। মানবজমিন