ডেস্ক রির্পোট:- সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কের প্রধান ফটকের সামনেই বড় সাইনবোর্ডে রিসোর্টের নাম লিখা। তার পাশেই ‘এই সম্পত্তি সোনালী ব্যাংক, লোকাল শাখা ঢাকার নিকট দায়বদ্ধ’ লেখা একটি আরেকটি সাইনবোর্ড সাঁটানো। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের স্ত্রী-সন্তানদের মালিকানার এই রিসোর্টটি আদালতের নির্দেশে ক্রোক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বেনজীর আহমেদের স্ত্রী- সন্তানদের নামে থাকা সাভানা পার্কের ভেতরে মৎস্য খামারের জন্য ৪ কোটি ১৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংকের লোকাল শাখা থেকে। ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বেনজীরের স্ত্রী জীশান মির্জার প্রতিষ্ঠানের নাম সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভস। এতে অংশীদার রয়েছেন তাদের দুই মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর। প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সোনালী ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে ২০১৯ সালের ১৪ই নভেম্বর এবং ২০২০ সালের ১৫ই জুন ঋণ আবেদন করা হয়। ব্যাংকের কাছে দেয়া আবেদনে সাভানা ফার্ম প্রোডাক্টসের প্রকল্প মূল্য উল্লেখ করা হয় ৮ কোটি ৬৬ লাখের কিছু বেশি। প্রকল্প ঋণ ইকুইটি অনুপাতে মঞ্জুর করা হয়েছে ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ৭ বছর মেয়াদে ২০২১ সালের মার্চে এই ঋণ মঞ্জুর করা হয়।
যার জন্য বেনজীরের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা সাভানা ইকো পার্কের ৭০৯ শতাংশ জমি বন্ধক রাখে ব্যাংক। ঋণ অনুমোদন পত্রে বলা হয় উক্ত ঋণের টাকা সাভানা ফার্ম ইকো পার্কের মৎস্য ইউনিটের দালান, পুকুর খনন, স’ানীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়, যানবাহন খাতে ও নির্মাণকালীন সুদে উক্ত ঋণ ব্যবহার করা হবে।
অবশ্য এই খাতে পুরো টাকাটা ব্যবহার হয়নি বলে জানা গেছে। রিসোর্টে মৎস্য ইউনিটের জন্য খনন করা হয় ২১টি পুকুর। যা ৫০ একরের মতো। প্রতি একর খনন ও অন্যান্য ব্যয়ে প্রয়োজন হয় সর্বো”চ ১ লাখ টাকা। এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার। এই হিসাব ধরেও সাভানা ফার্ম প্রোডাক্টস নির্মাণ ব্যয় ৫০ লাখের বেশি কিছু। ঋণের বাকি টাকা গেল কোথায়- এ নিয়েও চলছে দুদকের অনুসন্ধান। দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, এই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করতে পারেন। এমনটা যদি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তাহলে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হবে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। আদালতের নির্দেশে সাভানা পার্কের দায়িত্বে থাকা গোপালগঞ্জ জেলার কৃষি কর্মকর্তা বিজন কুমার নন্দী বলেন, এই পার্কের মধ্যে ছোট- বড় একুশটি পুকুর রয়েছে। আনুমানিক সব মিলিয়ে ৫০ একর হতে পারে। জমির মূল্য বাদে ঘের তৈরি ও চাষাবাদ বাবদ একর প্রতি ১ লাখ টাকা ধরলে সর্বনিম্ন ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। বর্তমানে এ বিষয়ে সার্ভে চলছে, সার্ভে রিপোর্ট হাতে আসলে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হবে। এদিকে মঙ্গলবার সরজমিন দেখা যায়, মৎস্য ইউনিট ছাড়াও ব্যাংকের বন্ধকী নোটিশ বেনজীরের রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় টানানো। রিসোর্ট কর্মীদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, স্যার তো শুনছি রিসোর্ট ব্যাংক থেকে লোন করে বানাইছে।
রিসোর্টের ফটকের সামনেই বড় করে লেখা সোনালী ব্যাংকের বন্ধকী নোটিশ। স্থানীয় বাসিন্দা হারাধন বলেন, ভেতরের মৎস্য খামারের জন্য লোন নিছে শুনছি। কিন‘ অনেক জায়গায় নোটিশ দেয়া আছে। তাহলে কি পুরো রিসোর্টই ঋণ করে করা?
জমি দখলের অভিযোগ: সাভানা পার্ক যে কৃষিজমির ওপর নির্মিত হয়েছে তার অধিকাংশ জমি নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করার পাশাপাশি প্রকৃত মালিকদের বিভিন্ন কৌশলে হামলা-মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে জবরদখল করা হয়েছিল। ভুক্তভোগীরা তৎকালীন সময়ে পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারলেও বর্তমানে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। ডোমরাশুর ও মাঝকান্দি গ্রামের নিরীহ কৃষকদের ভূমি দখল করতে সাহায্য করেছে ওই এলাকার লাঠিয়াল হিসেবে পরিচিত সুজয় পোদ্দার ওরফে হারাধন এবং অপূর্ব বল। এই দুজনে বেনজীরের পুলিশের প্রভাব ও নিজেদের পেশিশক্তি ব্যবহার করে প্রথমে কৃষকদের হয়রানি শুরু করতেন; একপর্যায়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতেন তারা। এমনটাই জানিয়েছেন ডোমরাশুর ও মাঝকান্দী গ্রামের বিপুল বল, কৃষ্ণ হালদার ও গিরিশ চন্দ্র ঘরামি।
রিসোর্টের কর্মী নেমেছে অর্ধেকে: সাভানা ইকো পার্কে অন্তত ৭০ জন কর্মী ছিলেন। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে প্রায় ৩৫ জন কাজ ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে ৩৫ জনের মতো কর্মী বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এই কর্মী মৎস্য চাষ, কৃষি আবাদ, সিকিউরিটি গার্ড, কটেজ দেখভাল, জিমনেসিয়ামের দায়িত্বে রয়েছেন। এরা মূলত বেতন-ভাতা না পাওয়ার ভয়ে ও আইনি ঝামেলা এড়িয়ে থাকতে চাকরি ছেড়েছেন। এদিকে কর্মী সংকট হওয়ায় সাভানা পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। মাছের পুকুরে নিয়মিত খাবার দেয়া হচ্ছে না। পার্কের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাকিল আহাম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, সামনে ঈদ। কর্মীদের বেতন-ভাতা না দিতে পারলে বাকি কর্মীরাও চলে যাবে।মানবজমিন