ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে ২০১৭ সালে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) শুরু করে হংকংভিত্তিক বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী লাওস গ্রুপ। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গাজীপুরের দক্ষিণ সালনা ও বাইপাসে গড়ে তোলে দুটি অ্যাপারেল কম্পানি। এতে কর্মসংস্থান হয় দেশি-বিদেশি প্রায় পাঁচ হাজার বেকারের। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স সংশোধনী ও নবায়ন না হওয়ায় ১৮ বিঘার ওপর নির্মিত লাওস গ্রুপের কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের উৎপাদন বন্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, লাওস গ্রুপের মতো বিদেশি শিল্পগোষ্ঠীর বিনিয়োগে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন মেয়র জায়েদা খাতুনের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম। অথচ বৈশ্বিক সংকটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু দেশে ব্যবসারত বহুজাতিক কম্পানির ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন, সংশোধনী না করে সরকারের কর্মকৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন জাহাঙ্গীর আলম।
অভিযোগ রয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির ওপর থাবা পড়েছে জাহাঙ্গীর আলমের।
তিনি প্রতিষ্ঠানটির ঝুট ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। এভাবে জাহাঙ্গীরের ঝুট ব্যবসার থাবা পড়েছিল গাজীপুরের কোনাবাড়ীর কোরিয়ান মালিকানাধীন নিউ টাউন নিটওয়্যার কম্পানির (এনটিকেসি) ওপর। ১৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির বৈধ ঝুট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন চিশতীকে বিতাড়িত করেন। সেই সঙ্গে এনটিকেসির ঝুট ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন জাহাঙ্গীর।
দীর্ঘদিন ঘুরেও লাইসেন্স সংশোধন করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) সমস্যাটি জানিয়ে চিঠি দেয় কলোট্যাক্স অ্যাপারেল লিমিটেড। এরপর বিডা থেকে দুই দফা চিঠি দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনকে। সেই চিঠিতে কাজ না হওয়ায় একাধিকবার ফোন করে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স দ্রুত সংশোধন করে দিতে অনুরোধ জানায় বিডা।
শতভাগ রপ্তানিমুখী বিদেশি প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স সংশোধন ও নবায়নের জন্য গুরুত্ব দিয়ে বিডার চিঠিতে বলা হয়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এমন কর্মকাণ্ড চলমান থাকলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ‘বিনিয়োগ বিকাশ’ বাধাগ্রস্ত হবে। কলোটেক্সের “ট্রেড লাইসেন্স সংশোধন না হলে দেশের বিনিয়োগে পরিবেশ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা যাবে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ হ্রাস পাবে। যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ‘বিনিয়োগ বিকাশ’ বাধাগ্রস্ত হবে।” এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের ট্রেড লাইসেন্স সংশোধনী ইস্যু করার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
তবে বিডার চিঠিকে পাত্তা দেয়নি গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে দেওয়া চিঠিকে আমলে না নিয়ে উল্টো কলোটেক্স কারখানার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ব্যবস্থাপক নুরুল আমিনকে শাসান তিনি। বিডাকে কেন চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হলো, সেই বিষয়ে নুরুল আমিনকে জেরাও করেন। নুরুল আমিন বলেন, ‘লাইসেন্স সংশোধন ও নবায়নের জন্য আবেদন করার পর মাসের পর মাস যাচ্ছে, কিন্তু সমাধান পাচ্ছি না। আটকে আছে মেয়রের পুত্র জাহাঙ্গীর আলম সাহেবের কাছে। নিরুপায় হয়েই আমরা বিডার কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর বিডার চিঠিও আমলে নিচ্ছে না। কেন বিডায় চিঠি দিলাম, সে জন্য ডেকে নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর বিডার চিঠি দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলতে থাকেন, এসব বিডার চিঠি ১০টা এলেও কাজ হবে না, আগে আমার সঙ্গে সব কিছু ফায়সালা করতে হবে। আমাকে ডিঙিয়ে বিডায় গিয়ে লাভ নেই।’
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স কর্মকর্তা গোলাম মুস্তফা বলেন, কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের সঙ্গে অন্য ঝামেলা আছে। সে জন্য লাইসেন্স সংশোধন হচ্ছে না।
লাইসেন্স সংশোধনে তাঁর কিছু করার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে লাইসেন্স সংশোধনের ফাইল আসার পর আমরা সব কাজ করে মেয়র মহোদয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। মেয়র এটি দিচ্ছেন না।’
মেয়র কেন দিচ্ছেন না—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মেয়র কিভাবে দেবেন। উনার ছেলে সাবেক মেয়র মহোদয় উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের অনুমতি ছাড়া তো উনি কিছুতে স্বাক্ষর করতে পারেন না। মূলত জাহাঙ্গীর আলমই কলোটেক্সের লাইসেন্স সংশোধনীর ফাইল আটকে রেখেছেন।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ২৮ জুলাই ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের জন্য কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের পক্ষে উইলসন ইয়াং আবেদন করেন। কিন্তু সেই সময় লাইসেন্স প্রদানে গড়িমসি শুরু করেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ওই সময় কম্পানি মালিক উইলসন ইয়াংকে নিজ দপ্তরে ডেকে নিয়ে ঝুট ব্যবসা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মেয়র জাহাঙ্গীরকে ঝুট ব্যবসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আবেদনের চার মাস পর কারখানাটির ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা হয়।
অনুসন্ধানে কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের একটি নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে (অঞ্চল-৫) আবেদন করে কম্পানিটি। এতে ট্রেড লাইসেন্সে মালিক বা মনোনীত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংশোধনের আবেদন করে কম্পানিটি।
এ সময় বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইলসন ইয়াংয়ের পরিবর্তে লিয়াং কা চিং কেভিনসের নাম সংশোধনের আবেদন করা হয়। এরপর আট মাস অতিবাহিত হলেও ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ও সংশোধন করেনি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। যদিও এর আগে ১৮ জুলাই ও ৭ আগস্ট দুই দফায় যথাক্রমে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা কম্পানিটি থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশনে লাইসেন্স সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। জমা দেওয়া আবেদনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট অব টেক্সটাইলের সহকারী পরিচালকের স্বাক্ষরিত নথিতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কলোটেক্স অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইলসন ইয়াংয়ের পরিবর্তে লিয়াং কা চিং কেভিনসের নিয়োগ দেওয়া হয়। লিয়াং কা চিং কেভিনস চীনের নাগরিক। যিনি ক্লেবার ট্রেডার্স হোল্ডিং লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক (নমিনিটেড ডিরেক্টর)। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানে আরো দুজন পরিচালক রয়েছেন। তাঁরা হলেন হও কার ও এবং এনজি সিউ প্যাং টেরি। এর মধ্যে হও কার ও হচ্ছেন ক্লেবার ট্রেডার্স হোল্ডিং লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক। এ ছাড়া এনজি সিউ প্যাং টেরি এভারসিটি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক।
ট্রেড লাইসেন্সে মালিক বা লাওস গ্রুপের মনোনীত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের সংশোধনের জন্য আবেদনের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় চলতি বছরের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে আবেদন করে কম্পানিটি। আবেদন পাওয়ার দিনই, অর্থাৎ ৪ এপ্রিল গাজীপুরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় বিডার সহকারী পরিচালক মো. আতিক সরকার।
বিডার প্রথম চিঠির প্রায় দুই মাস পর আরো দুই মাস পেরোলেও কম্পানিটির লাইসেন্স এখন পর্যন্ত নবায়ন করেনি সিটি করপোরেশন।
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম সফিউল আজম বলেন, ‘আমার কাছে আবেদনটির সব প্রক্রিয়া শেষ করে মেয়র মহোদয়ের কাছে পাঠানো হয়। এখন সেই ফাইলটি কী অবস্থায় আছে, সেটি আমার জানা নেই।’
জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে বিডার ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনের এক্সিকিউটিভ মেম্বার গ্রেড-১ মহসিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘গাজীপুরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ট্রেড লাইসেন্সে সমস্যা হচ্ছে, সেটি আমরা অবগত আছি। কলোটেক্স অ্যাপারেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘কলোটেক্সের অভিযোগর পর আমরা দুই দফা গাজীপুর সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি দ্রুত লাইসেন্স দিতে। প্রথমবার গত ৪ এপ্রিল চিঠি দিয়েছি। সিটি করপোরেশন তার পরও লাইসেন্স দেয়নি। এরপর সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে লাইসেন্স দিতে আমরা চিঠি দিয়েছি। সেই সঙ্গে দ্রুত লাইসেন্স দিতে একাধিকবার সরাসরি ফোন করে তাগাদা দিয়েছি। তার পরও সিটি করপোরেশন লাইসেন্স না দিলে সেটি হবে দুঃখজনক।’
লাওস গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় লাওস গ্রুপ। ৪৯ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ছাড়াও হংকং, চায়না, মিয়ানমার, ভিয়েতনামেও প্রতিষ্ঠানটির কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুডেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের খুচরা শোরুম রয়েছে। তাদের প্রায় ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।কালের কণ্ঠ