রাঙ্গামাটি ডেস্ক: – পার্বত্য চট্টগ্রামের চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যকার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিরোধের মধ্যেও স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন ঘিরে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতার মধ্যেই ভোটকে ঘিরে ঐক্য করেছে পাহাড়ের প্রধান দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে নির্বাচনের ‘সুষ্ঠু পরিবেশ নেই’ বলে ভোটে অংশগ্রহণ না করলেও উপজেলার ভোটে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির জানান দিতে চাইছে আঞ্চলিক দলগুলো। বিশেষত ইউপিডিএফ–জেএসএসের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেই একমুখী অবস্থান নিয়েছে দল দু’টি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দৃশ্যত চারটি আঞ্চলিক দল দুইটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে আছে। কৌশলগত কারণে জাতীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকেও নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ার কথা বলছে তারা। এরমধ্যে ইউপিডিএফ–জেএসএস একমুখী অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এমএন লারমা) বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। মূলত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটির সঙ্গে জেএসএস (এমএন লারমা)-এর রাজনৈতিক সখ্যতা রয়েছে। তবে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া সন্তু লারমার জেএসএস ও চুক্তির ঘোর বিরোধিতা করা প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের মধ্যকার রাজনৈতিক মতানৈক্য ও বিরোধ দৃশ্যমান। ভোট ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেও ঐক্য হয়েছে জেএসএস–ইউপিডিএফের।
আগামী ২৯ মে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও লংগদু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আয়তন ও ভৌগলিকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি। উপজেলাটিতে আগামী ২৯ মে তৃতীয় ধাপের অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৯ জন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ঘোড়া প্রতীকে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা ও আনারস প্রতীকে বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের সদ্য–সাবেক চেয়ারম্যান অলিভ চাকমা ভোটে লড়ছেন। সুদর্শন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ–সাধারণ সম্পাদক ও অলিভ চাকমা জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ–সভাপতি।
ভাইস চেয়ারমানে পদে এ উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন পাঁচজন; তারা হলেন– বই প্রতীকে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম, তালা প্রতীকে দীপ্তিমান চাকমা, উড়োজাহাজ প্রতীকে নিখিল জীবন চাকমা, চশমা প্রতীকে মো. আনোয়ার হোসেন ও টিউবওয়েল প্রতীকে লড়ছেন মো. মনসুর আলী। অন্যদিকে, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ফুটবল প্রতীকে লড়ছেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সাগরিকা ও সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুমিতা চাকমা প্রজাপতি প্রতীকে। ভোটাররা বলছেন, মূলত দুজন করে প্রার্থী হওয়ায় চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দৃঢ় ভোটযুদ্ধ হবে বাঘাইছড়িতে।
নানিয়ারচর উপজেলায় মোট প্রার্থী হয়েছেন ৮ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা কাপ–পিরিচ, রুপম দেওয়ান দোয়াত–কলম, জ্যোতিলাল চাকমা মোটর–সাইকেল ও অমর জীবন চাকমা আনারস প্রতীকে লড়ছেন। চারজনের মধ্যে প্রগতি চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাবেক সহ–সভাপতি, রুপম দেওয়ান বর্তমান উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। জ্যোতিলাল চাকমা নানিয়ারচর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও অমর জীবন চাকমা ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। জ্যোতিলাল ও অমর জীবন দুজনই ইউপিডিএফের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাইস চেয়ারম্যান পদে সুজিত তালুকদার টিউবওয়েল ও বিনয়কৃষ্ণ চাকমা বই প্রতীকে লড়ছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা প্রজাপতি ও অনিতা চাকমা কলস প্রতীকে লড়ছেন।
অন্যদিকে, লংগদু উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার ঘোড়া প্রতীক, বাবুল দাশ (বাবু) আনারস প্রতীক, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দোয়াত কলম ও প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান আবছার আলী মোটর–সাইকেল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। তাদের মধ্যে আব্দুল বারেক সরকার লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বাবুল দাশ বাবু বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বর্তমান সহ–সভাপতি। অন্যদিকে আবছার আলী এক সময় রাঙামাটি জেলায় বাঙালি জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠন ‘সম–অধিকার আন্দোলনের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন টিউবওয়েল প্রতীকে তোফায়েল আহমেদ বাবুল, বই প্রতীকে রকিব হোসেন ও চশমা প্রতীকে কল্যাণ প্রিয় চাকমা। অন্যদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারা বেগম ফুটবল প্রতীকে ও ফাতেমা জিন্নাহ কলস প্রতীকে।
রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ মেরুকরণ বরাবরের মতোই বৈচিত্র্যময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) প্রার্থী হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিশাল অংশের সমর্থন পাচ্ছেন সুদর্শন চাকমা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও উপজেলায় ইউপিডিএফ–জেএসএসের পূর্ণ সমর্থনে ভোটের মাঠে নেমেছেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা অলিভ।
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদে প্রগতি চাকমা জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সাবেক নেতা এবং রুপম দেওয়ান বর্তমানে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক; যদিও দলের সমর্থনই পাননি রূপম। অন্য দুজন হলেন জ্যোতিলাল চাকমা ও অমর জীবন চাকমা। তারা দুজনই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপিডিএফের ঘরানার হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তবে শেষাবদি দুজনের একজনই পাচ্ছেন ইউপিডিএফের দলীয় সমর্থন।
লংগদু উপজেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিকদলগুলোর কোনো প্রার্থী নেই। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আনারস প্রতীকের প্রার্থী বাবুল দাশ বাবুকে সমর্থন দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। উপজেলায় শক্ত সাংগঠনিক অবস্থানে থাকা জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত ভোট কার ঝুলিতে ঢুকবে সেটি এখনো ধোঁয়াশায় রয়েছে।
ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘পাহাড়ের নির্বাচনগুলোতে পার্টির অবস্থান থাকে। এবারও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পার্টি। আমরা বিভিন্ন উপজেলায় জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমরা জেএসএসকে সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতাদশিৃক বিরোধ আগের মতো রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বা বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে পার্টি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। যাতে করে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতসহ অন্যান্য সমস্যাবলীর সমাধান আসে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুপিটার চাকমা বলেন, ‘বাঘাইছড়ি উপজেলায় আমাদের দলের সমর্থিত প্রার্থী সুদর্শন চাকমা। লংগদুতে আমাদের দলের সমর্থন দেওয়া হয়েছে বাবুল দাশ বাবুকে (উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)। তবে নানিয়ারচর পার্টির উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রূপম দেওয়ান ভোট করলেও তাকে আমাদের দলের সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না।’
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দলটির মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ–সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, ‘তৃতীয় ধাপের ভোটে রাঙ্গামাটির কোনো উপজেলায় আমাদের কোনো প্রার্থী নেই। তবে বাঘাইছড়িতে জেএসএস – এনএম লারমার নেতা সুদর্শন চাকমাকে আমরা দলীয় সমর্থন দিয়েছি। অন্য দুটি উপজেলা নানিয়ারচর ও লংগদুতে সাধারণ জনগণ যাকে বেছে নেবেন, যার বেশি জনপ্রিয়তা রয়েছে; কৌশলগত বিষয় বিবেচনা করেই আমরা সমর্থন জানাব।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নেত্রী বলেছেন যার যত জনপ্রিয়তা আছে তা যাচাই করে দেখতে। যেখানে আমাদের দলের সমর্থনে একক কোনো প্রার্থী নেই। সেখানে আলাদা করে কাউকে সমর্থন দেওয়ার তো কথা আসে না। যে যার মতো করে ভোট করছেন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।’
প্রসঙ্গত, তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠেয় রাঙ্গামাটির তিন উপজেলার মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ জন। বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৭৮ হাজার ২৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৪০ হাজার ৭৯৬ জন, নারী ভোটার ৩৭ হাজার ২৩২ এবং হিজড়া রয়েছেন ১ জন। ভোটকেন্দ্র ৩৯টি। লংগদু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬১ হাজার ২৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৩১ হাজার ৮৭৭ জন, নারী ভোটার ২৯ হাজার ৩৮৬। ভোটকেন্দ্র ২৩টি। নানিয়ারচর উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬৮৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১৯ হাজার ৮৩২ জন, নারী ভোটার ১৮ হাজার ৮৫৭। ভোটকেন্দ্র ১৪টি।