ডেস্ক রির্পোট:- ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইব্রাহিম রাইসি কী সত্যি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল! সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এমন প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চায়ের আড্ডা- সব জায়গাই এই আলোচনা। অনেকে সন্দেহ করছেন তিনি নেহায়েতই একটি দুর্ঘটনার শিকার হননি। এর পেছনে অন্য অনেক কারণ থাকতে পারে। কি সেই কারণ? বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তা। তিনি যে হেলিকপ্টারে করে তিবরিজে ফিরছিলেন, তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি বেল-২১২ হেলিকপ্টার। এ হেলিকপ্টারগুলো ৩০ বছরের পুরনো একটি হেলিকপ্টার। ১৯৯৪ সালে তা নির্মাণ করা হয়েছে। সাবেক শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সময়ে এটি কিনেছিল ইরান। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি কি এতই পুরনো ছিল কিনা, সেটা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল কিনা।
নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ইরান তার বিমান ও হেলিকপ্টার পাচার করে নেয়া যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে মেরামত করে থাকে। বহরে থাকা বাকি দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে চলে যেতে পারলে, প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটিই কেন দুর্ঘটনায় পড়লো! এক্ষেত্রে পাইলট ও ফ্লাইট পরিকল্পনাকারীরা কি কোনো চেক করেছিলেন! এক্ষেত্রে কি তাদের কোনো অবহেলা ছিল।
কেন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ওই হেলিকপ্টারে আরোহণ করলেন। তার নিরাপত্তা রক্ষীরা তখন কী করেছিলেন। কেউ কি প্রেসিডেন্ট রাইসিকে একবারও হুঁশিয়ার করেছেন! চারদিকে যখন শত্রু, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে- তখন তার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র ছিল কিনা! বিশেষ করে যে আজারবাইজানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রাইসি ড্যাম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন, সেই আজারবাইজান হলো ইসরাইলের মিত্র। ভীষণ ঘনিষ্ঠতা ইসরাইল-আজারবাইজানের মধ্যে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক আছে আজারবাইজানের। তাহলে কেন এমন পরিস্থিতির মধ্যে ওই ড্যাম উদ্বোধন শেষে রাইসিকে পুরনো একটি হেলিকপ্টারে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়তে দেয়া হলো! এমন প্রশ্নের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি বিষয়। তা হলো- ঘরের কাছেই শত্রু ইসরাইল। দেশটির সঙ্গে ইরানের দা-কুমড়ো সম্পর্ক। একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ লাগতে লাগতে থেমে গেছে উভয় পক্ষ।
ফলে সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিষয়ে। কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনার সঙ্গে মোসাদের কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। অবশ্য, সোমবার বিবিসিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে ইসরাইলের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ঘটনায় ইসরাইল জড়িত নয়। তবে ইসরাইল এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন নিউজউইকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সন্দেহের তালিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রোববার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তিনি একই সঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং বর্তমান সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির যোগ্য উত্তরাধিকারীর দাবিদার ছিলেন। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খামেনির ছেলে মুজতবা খামেনিও ওই পদের দাবিদার বলে জল্পনা আছে।
তিনিও পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে দেশের সুপ্রিম নেতা হওয়ার খায়েশ করেন। তবে তিনি এখনো কোনো সরকারি পদে সক্রিয় নন। কিন্তু সুপ্রিম নেতার অফিসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এসব কারণে প্রশ্ন উঠছে তাকে ঘিরেও। রিপোর্টে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। কার্নেই এনডোমেন্ট ফর ইন্ট্যারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো করিম সাজাপুর রোববার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, রাইসি’র মৃত্যু ইরানে উত্তরাধিকারের সংকট সৃষ্টি করবে। বর্তমান সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ছেলে মুজতবা খামেনি এবং প্রেসিডেন্ট রাইসি এই উত্তরাধিকারের প্রার্থী ছিলেন বলে জল্পনা আছে। ইরানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঘোলাটে। তাই খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেন যে, ইব্রাহিম রাইসি নিছক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তারা মনে করেন ৬৩ বছর বয়সী রাইসি সেই ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হয়ে থাকতে পারেন। নিউজউইক লিখেছে, প্রেসিডেন্ট রাইসি’র মৃত্যুর জন্য খুব দ্রুততার সঙ্গে ইরানের দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক শত্রু ইসরাইলের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। ইসরাইলি টিভি স্টেশন চ্যানেল ১৩-এর মতে, ইসরাইল এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় ইসরাইল জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরাইলের দিকে আঙ্গুল তুলে অভিযোগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় সাংবাদিক ইয়াশার আলি এক্সে লিখেছেন, স্মরণ রাখবেন। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র রাইসি’র মৃত্যুর জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেনি। সুতরাও আপনাদেরও করা উচিত হবে না। এক্সে কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে রাইসি’র মৃত্যুর খবর প্রকাশ হওয়ার আগেই ইসরাইলি মিডিয়া তা নিশ্চিত করেছে। এমনকি ফরাসি একটি টিভি স্টেশনের একজন রিপোর্টার পর্যন্ত ভুল করে টেলিগ্রামে এ বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে দেন। তাতে বলা হয়, ইলি কপ্টার নামে একজন মোসাদ এজেন্ট ওই হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন। উল্লেখ্য, এমনিতেই ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকারে রয়েছে। তাতে এই দোষারোপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে। বিতর্কিত আরেকটি ইস্যু হলো ইরানের ভেতরেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন।
তারা ইরানের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য পরিচিত। এপ্রিলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তাদের বেশ কয়েকটি হামলায় কয়েক ডজন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই হামলার দায় স্বীকার করে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিট্যান্ট গ্রুপ জৈশ আল আদল। তারা ইরান-পাকিস্তান সীমান্তে তাদের অভিযান পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার তাদের গুলি করে নামানোর সক্ষমতা আছে বলে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে প্রেসিডেন্ট রাইসি’র সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের শত্রুতা ছিল। ওদিকে অনলাইন সাফাক নিউজ বলেছে, তুরস্কের পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল কাদির উরালোগলু এই কপ্টার দুর্ঘটনা নিয়ে ‘গুরুতর সমস্যার’ কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী কপ্টারে হয়তো সিগন্যালিং সিস্টেম ছিল না; না হয় তা ছিল অকার্যকর। ওদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস বলেছে, ইরানি সরকারি সূত্রগুলোই বলছে, সেখানে পরিবেশ ছিল নাজুক। বিশেষ করে কুয়াশায় ঘেরা ছিল। এটা উদ্বেগের কারণ।
সোমবার নিষেধাজ্ঞার কারণে এমন ঘটনার কথা প্রত্যাখ্যান করে হোয়াইট হাউস। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি এমন অভিযোগকে নিরেট ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই দুর্ঘটনার কোনো কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। অনলাইন আল-জাজিরা বলেছে- হেলিকপ্টারটি কীভাবে বিধ্বস্ত হলো, তা খতিয়ে দেখতে দুর্ঘটনার পরদিন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইরান। এ বিষয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে রাশিয়া বলেছে, ইব্রাহিম রাইসি’র হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করতে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দিতে প্রস্তুত তারা। রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের কারণ সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি (ইএএসএ) বলছে, উঁচু পার্বত্য এলাকা ও গভীর উপত্যকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পাইলট বিভ্রান্ত হতে পারেন। এ ধরনের পরিবেশে চলাচল করা একজন পাইলটের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত ক্লান্তির। ইএএসএ বলছে, গভীর উপত্যকায় বাতাসের গতি ও দিক আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে পাল্টে যেতে পারে। এ কারণে বাতাসের গতি উল্লেখ করার মতো ওঠানামা করতে পারে। এতে করে অনেক সময় হেলিকপ্টারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন পাইলট। এ ছাড়া এসব জায়গা দিয়ে চলাচলের সময় কুয়াশা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি বিষয়। তবে কাইল বেইলি নামের একজন বেসামরিক বিমান পরিবহন বিশেষজ্ঞ আল-জাজিরাকে বলেন, বিধ্বস্ত হওয়ার আগে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের পাইলটরা সহায়তা চেয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি। ফলে কোনো সন্দেহ নেই যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই হেলিকপ্টারটি নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যার মুখে পড়েছিলেন তারা।