ডেস্ক রির্পোট:- প্রযুক্তি সহজ করে দিয়েছে দালাল সিন্ডিকেটের দালালি। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে তারা। আর এতে দুর্নীতির ধরন বদলেছে সরকারি দপ্তরগুলোর দুর্নীতির স্টাইল। এখন দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যদের ফাইল নিয়ে অফিসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়াতে হয় না। অফিসের পাশে গড়ে ওঠা কম্পিউটার বা ফ্লেক্সি লোডের দোকানে বসে চালান সকল কার্যক্রম। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ি রেজিস্ট্রেশন, নাম পরিবর্তন, পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে জন্মনিবন্ধন- সবকিছুই টাকার বিনিময়ে সহজেই হয়ে যায় মোবাইলের হোয়াটস অ্যাপ বা ইমোতে কাগজ চালাচালির মাধ্যমে।
সরজমিন মিরপুরস্থ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের ভিতরে আগের মতো দালালের নেই হাঁকডাক। গ্রাহকরা নিজেরাই নিজেদের ফাইল জমা দিচ্ছেন। কিন্তু গেটের বাইরে বেশ জটলা। ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন দালাল চক্রের সদস্যরা। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, নাম পরিবর্তন কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স সবই মুহূর্তের মধ্যে করে দেন তারা।
দেনা-পাওনায় রাজি হলেই গ্রাহককে তারা নিয়ে যান বিআরটিএ অফিসের পাশের রাস্তার ‘ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’-এর মিরপুর বুথ নামে একটি টেলিকমের দোকানে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাইনবোর্ড লাগানো থাকলেও মিরপুর-১০ এর ১ নং রোডের ৪২ নম্বর প্লটের এই দোকানে ফটোকপি, ছবি থেকে ছবিসহ সকল প্রকার স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। কমিশনের ভিত্তিতে বিআরটিএ’র দালাল চক্রের সদস্যরা এখানের টেবিল চেয়ার ব্যবহার করেই তাদের কাস্টমারদের স্ট্যাম্প লেখাসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন। বিআরটিএ’র ফি ওই দোকান থেকেই পরিশোধ করেন তারা। এরপর ফাইলের ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। এরপর ফাইল নিয়ে গ্রাহককে পাঠিয়ে দেয়া হয় অফিসের ভিতর। নানা অযুহাতে সাধারণ মানুষের ফাইলের কাজ না হলেও দালাল চক্রের পাঠানো ফাইল ঠিকই সম্পন্ন হয়ে যায়। এমনই একজন তারক দত্ত। চাকরি পাওয়ার পর টাকা জমিয়ে টিভিএস কোম্পানির রাইডার মডেলের একটি মোটরসাইকেল কেনেন। কিন্তু গাড়ি চালানোয় ভালো পারদর্শী না হওয়ায় মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দেন তার বন্ধুর কাছে। টাকা-পয়সার লেনদেন হলেও বাকি ছিল গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের নাম পরিবর্তন। তাই নাম পরিবর্তন করতে উভয়পক্ষই দ্বারস্থ হন মিরপুর বিআরটিএ অফিসে। কিন্তু সরাসরি অফিসে গেলেও ভোটার আইডি কার্ড, ছবি, ফটোকপিসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাদের দুই দফা ফিরিয়ে দেয়া হয়। চাকরি ফেলে মোহম্মদপুর থেকে বারবার মিরপুর যাওয়া সম্ভব নয় বলে তিনদিনের মাথায় তিনি ছোটেন দালাল চক্রের কাছে। কথা হয় ফোরকান নামে এক দালালের সঙ্গে। পাঁচ হাজার টাকায় রফাদফার পর তারক ও তার বন্ধু রাজীবকে নিয়ে যান সেই ‘ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’-এর সাইনবোর্ড লাগানো টেলিকমের দোকানে। কাগজপত্র সম্পাদন করে বিআরটিএ’র ফি পরিশোধ করা হয় ওই দোকান থেকেই। সব কাজ শেষে স্ট্যাম্প প্রিন্ট করে কাগজের ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয়া হয় জনৈক ব্যক্তির কাছে। এরপর তারকের হাতে ফর্ম দিয়ে নির্দিষ্ট বুথের সামনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে ভিড় থাকায় কিছুক্ষণ পর ফোরকান নিজেই যান তাদের সঙ্গে। গাড়ি পরিদর্শন থেকে শুরু করে সবশেষ ফাইল জমা দেয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করে দেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী তারক দত্ত বলেন, আমি একটি বেসরকারি চাকরি করি। এর আগে দুইদিন এখানে এসেছি। প্রথমদিন এলে বলা হয়, ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপিসহ গাড়ির সকল কাগজপত্র লাগবে। দ্বিতীয়দিনে আবার অফিস বাদ দিয়ে সকল কাগজ নিয়ে আসি। সেদিন আবার অরিজিনাল ভোটার আইডি লাগবে বলে আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমি বার বার করে আনসার সদস্যকে বলি আমার এভাবে প্রতিনিয়ত আসা সম্ভব নয়। আমি একটু অফিসারের সঙ্গে কথা বলি, যে ফটোকপি দিয়ে হবে কি না। তিনি আমাকে ভিতরে প্রবেশই করতে দেয়নি। কিন্তু আমি দেখলাম দালাল ধরলে ঠিকই কাজ হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে দালালকে টাকা দিয়ে কাজ করিয়েছি। আমার মতো বেশির ভাগেরই একই অবস্থা।
এদিকে স্কুল-কলেজে ভর্তি, পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজন পড়ে জন্ম সনদের। কিন্তু এই জন্ম সনদ পেতে গেলে সবচেয়ে বেশি ঝক্কি পোহাতে হয়। কখনো সার্ভার পায় না, তো কখনো কাগজপত্র মেলে না। কিন্তু দালাল ধরলে এই কাজ মুহূর্তেই হয়ে যায়। আর এই দালাল তাদের সকল কাজ সারেন সিটি কর্পোরেশনের জোনাল অফিসগুলোর আশেপাশের টেলিকমের দোকান থেকে। কাগজপত্র সম্পাদন, অনলাইনে আবেদন সবই করেন সেখান থেকে। এরপর টাকার বিনিময়ে কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বের করে নিয়ে আসেন জন্ম-মৃত্যু সনদ। এমনই একজন রেজাউল ইসলাম। তিনি তার চার বছরের মেয়ের জন্ম সনদ করার জন্য দুই মাস ধরে ঘুরছিলেন নগর ভবনসহ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন দপ্তরে। কিন্তু সার্ভার জটিলতা, কাগজপত্র ঠিক নেইসহ বিভিন্ন অজুহাতে করতে পারেননি জন্ম সনদ। এরপর তার এক স্বজনের মাধ্যমে জানতে পারেন দালাল ধরলে খুব সহজেই পাওয়া যায় এই জন্ম সনদ। বাবা-মায়ের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ছাড়া তেমন কোনো কাগজই লাগে না। এরপর তিনি যোগাযোগ করেন মিজান নামে এক দালালের সঙ্গে। তার মাধ্যমেই দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে মাত্র এক সপ্তাহের মাধ্যমে হাতে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সেই জন্ম নিবন্ধন সনদ। দোকানের নাম না বললেও রেজাউল ইসলাম জানান, আমাকে মিজান একটি কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যায়। বলেন- এটা তার ভাইয়ের দোকান। সেখান থেকে অনলাইনে আবেদন করে। আমি শুধু তাকে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়েছি। বাকি কাজ তিনিই করেছেন। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি আমার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ হাতে পেয়েছি। তিনি বলেন, সাধারণভাবে এই কাজ করতে গেলে কত না ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে একই কাজ কত সহজে হয়ে যায়। আর এই সবই করে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে। তিনি বলেন, আসলে অসৎ উপায়ে টাকা কামাইয়ের জন্যই তারা সাধারণ মানুষকে এতো ভোগান্তিতে ফেলে। রেজাউল ইসলামের মতোই মো. রানাও সাধারণ উপায়ে মাসখানেক ঘুরেও বাচ্চার জন্য করতে পারেননি জন্ম সনদ। পরে তিনিও মিজানের শরণাপন্ন হন। তিনি বলেন, এতো ঘোরাঘুরি করে লাভ হয় না। টাকা দিলে সবই সহজে হয়ে যায়। দপ্তরেও যাওয়া লাগে না। কম্পিউটারের দোকান থেকে কাজ হয়ে যায়।
অপরদিকে দালাল ছাড়া সাধারণ পন্থায় পাসপোর্ট পেতেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সাধারণভাবে একটি পাসপোর্ট করতে গেলে অফিসের টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়। কেউ বলে কাগজপত্র ঠিক নেই, কেউ বলে ছবি ঠিক নেই। নানা অজুহাতে বাড়ে ভোগান্তি। কিন্তু দালাল ধরলে এতো কাগজ, মেডিকেল কিছুই লাগে না। তারা জায়গায় বসেই সব করে দেন। নিজেরাই করেন সত্যায়িত। ডাক্তারের সিল, স্ট্যাম্প সবই থাকে তাদের কাছে। টেলিকমের দোকানে বসেই মুহূর্তেই কাজ সেরে ফেলেন। এরপর ফরমের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোতে পাঠিয়ে দেয় অসাধু কর্মকর্তার কাছে। ওই ফরমের সাংকেতিক চিহ্ন দেখে তাকে আর আটকায় না কেউ। আর ফাইল দেখলেই কর্মকর্তা কমিশন হিসেবে সেটা রাখেন বিশেষ ক্যাটাগরিতে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিআরটিএ’র কর্মকর্তারাও। মানবজমিন