শিরোনাম
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই: সেনাপ্রধান পার্বত্য তিন জেলায় প্রাণ ফিরেছে পাহাড়ি পর্যটনে দুদকের গোড়াতেই গলদ-অস্বচ্ছতা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না: তারেক রহমান গাজায় নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু: জাতিসংঘ জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না : তারেক রহমান মাফিয়া ছিলেন ঢাকার এমপিরা নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজ বৈধ, মেয়াদ অনির্দিষ্ট অন্তবর্তীকালীন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন: স্থান পেয়েছে উপদেষ্টার সহকর্মীরা,জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

মিয়ানমারের আরাকানে যেভাবে গৃহযুদ্ধ চলছে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪
  • ১০২ দেখা হয়েছে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.):- মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল অংজিকে গাড়িতে নিয়ে ঘুমধুম সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করলাম…। এটি ছিল, ২০০৮ সালের ২৯ জুনের ঘটনা। তখন আমি টেকনাফের বিডিআর ব্যাটালিয়নে (বর্তমানে বিজিবি) কর্মরত। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সেক্টর পর্যায়ের মিটিং শেষে তৎকালীন লুনটিন বাহিনীর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি) প্রতিনিধি দলকে ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’ পেরিয়ে মিয়ানমারের (রাখাইন) ঢাকিবুনিয়া ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

এর প্রায় ১৬ বছর পর, আরাকান আর্মির (এএ) প্রচ- আক্রমণের মুখে ২০২৪ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি সময়কালে রাখাইনের প্রায় এই অঞ্চল দিয়েই মিয়ানমারের ৩৩০ জন সীমান্তরক্ষী (বিজিপি) পালিয়ে বাংলাদেশে এসে প্রাণ বাঁচালেন। এই বিস্ময়কর ঘটনা জানান দেয়, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) মধ্যকার লড়াইয়ের তীব্রতা। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বকোণে অবস্থিত রাখাইনে এখন সামরিক-জান্তার বাঁচা-মরার লড়াই। গৃহযুদ্ধে মিয়ানমার প্রায় ভেঙে পড়ছে।
২০২৩ এর ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ পরিচালিত ‘অপারেশন ১০২৭’ রাখাইনের প্রায় ৩৬ হাজার বর্গমাইলব্যাপী রণাঙ্গনে আরাকান আর্মির যুদ্ধকে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করেছে। বিশেষত ১৩ নভেম্বর থেকে তারা রাখাইনে বড় ধরনের অভিযান শুরু করে। দলটি রাজ্যের প্রায় ৭০% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। রাখাইন রাজ্যটি নেপিদোকেন্দ্রিক জান্তা সরকারের প্রায় হাতছাড়া হতে চলেছে। গৃহযুদ্ধের ভরকেন্দ্র এখন রাখাইন। রাখাইনের নতুন শেরিফ এখন আরাকান আর্মি।

প্রায় ৭৫ বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাতমাদোকে ‘অজেয় বাহিনী’ হিসেবেই মনে করা হতো। কিন্তু গত ৪ মাসে ৮টি ফ্রন্টে ইতোমধ্যে তাতমাদোর কয়েক হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। তাতমোদোকে এখন কেউ কেউ ‘হোয়াইট ফ্ল্যাগ আর্মি’ বা আত্মসমর্পণকারী সেনাবাহিনী বলেও অভিহিত করছে।

মধ্য রাখাইনের আন শহরে মিয়ানমার বাহিনীর ‘ওয়েস্টার্ন কমান্ডের’ সদর দফতর অবস্থিত। ২০২০ সাল থেকে এর অধিনায়ক হিসেবে কাজ করছেন মেজর জেনারেল থিন লাট ও। যার দায়িত্বে রয়েছে সমগ্র রাখাইনের সামরিক বিষয়।

রাখাইনে ১০টি শহরের পতন হয়েছে। শত শত সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। বিদ্রোহীদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতমাদো। কমান্ড পোস্টে ব্যস্ত সময় কাটছে জেনারেল থিন লাট ও এর। সামনে রাখাইনের বিশাল অপারেশনাল ম্যাপ। এই ম্যাপে লাল রং দিয়ে এএ এর আক্রমণের কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। ম্যাপের দিকে তাকিয়ে জেনারেলের মনে হচ্ছে আরাকান আর্মি যেন তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে।

২০২২ সালে আরাকান আর্মি প্রধান মেজর জেনারেল ‘তোয়াং ম্রা নায়েঙ’ এই জেনারেলকে টুইটারে মারাত্মক হুমকি দিয়েছিলেন। তখন রাখাইনে যুদ্ধ বিরতি চলছিল। আরাকান আর্মি প্রধান টুইট করেছিলেন… ‘‘থিন লাট ও, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করো না। আমি একদিন তোমার জায়গায় যাব ও তোমাকে ধ্বংস করবো।” রাখাইনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জান্তাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাই নিজেই যুদ্ধের খোঁজখবর নিচ্ছেন। অপারেশনের ব্যর্থতার জন্য তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘আঞ্চলিক কমান্ডার’ প্রচ- চাপের মুখে আছে।

এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত গেরিলা দল হলো আরাকান আর্মি। জান্তা সরকারের শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদে পূর্ণ স্বাধীনতার আশায়, ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল তারিখ মাত্র ২৬ জন আরাকানি তরুণ সহযোগীকে নিয়ে মেজর জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ ‘আরাকান আর্মি’ প্রতিষ্ঠা করেন। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির সহায়তায় কাচিন রাজ্যের লাইজায় এই গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়।

ক্যারিসমেটিক নেতা তোয়াং ম্রা নায়েঙ বর্তমানে থাকছেন চীন সীমান্তের কাছে শান রাজ্যের পাঙসাঙয়ে। যাকে আরাকান আর্মির অর্থনৈতিক সদর দফতর মনে করা হয়। তাদের রাজনৈতিক শাখা ‘‘ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান” এর নেতৃত্বেও রয়েছেন জেনারেল নায়েঙ। আরাকান আর্মির সদর দফতর হলো কাচিন রাজ্যের লাইজায়। এখানে অবস্থান করেন ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নিও টোয়ান আং। অন্যদিকে একটি ফাংশনাল হেডকোয়ার্টার চিন রাজ্যের পালেটওয়েতে। এমন অদ্ভুত নেতৃত্ব অবস্থায়ও জেনারেল নায়েঙ-এর গেরিলা-সৈনিকরা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে রাখাইনে তাতমাদোর বিরুদ্ধে লড়ছে প্রচ-ভাবে।

মাত্র এক দশকের মধ্যে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও কার্যকর জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা রাখাইনে এক ধরনের সমান্তরাল ছায়া প্রশাসনও চালু করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালে আরাকান আর্মি প্রধান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমাদের আসলে ৩০ হাজারের মতো সৈনিক আছে। আমাদের আপাতত ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার সৈনিক দরকার, পূর্ব পূরুষের ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য। আমাদের মূল লক্ষ্য ‘রাখিতা’- ‘‘হারানো সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়া”।

তবে আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিয়াং থু খা গত ৪ মার্চ বলেন, ‘‘আমরা পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরাকান গড়ে তুলব। আমরা স্বাধীনতা চাই না বরং মিয়ানমারের অধীনে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ব। আমরা চাই কনফেডারেশন।” অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে, রাখাইনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন বাস্তবসম্মত নয়।

মূলত বৌদ্ধ রাখাইনদের ঐতিহাসিক অধিকারের জন্য লড়ছে এ সংগঠন, যা রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আরাকান আর্মিতে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি সরব অবস্থান নারীদেরও। তাদের সৈন্যবল ২৫-৩০ হাজার (ইন্টেলিজেন্স ও অক্সিলারি সদস্যসহ) বলে মনে করা হয়।

বিভিন্ন সময় পরিচালিত সামরিক অভিযানে তারা যেসব অস্ত্র প্রদর্শন করেছে, তাতে স্বয়ং জান্তা বাহিনীও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। আরাকান আর্মির ভান্ডারে উন্নত অস্ত্র ছাড়াও তাদের সদস্যদের জন্য ভালো পোশাক, খাবার ও রেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। আরাকান আর্মির রয়েছে অনেকগুলো সুগঠিত পদাতিক ব্যাটালিয়ন। তাদের কয়েক হাজার গেরিলা কাচিন, শান ও সাগাইং অঞ্চলে অন্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাতমাদোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

রাখাইন স্টেট সামরিক দিক থেকে সামরিক বাহিনীর ‘ওয়েস্টার্ন কমান্ড’ এর অন্তর্ভুক্ত। এর সদর দফতর আরাকানের ‘আন’ শহরে অবস্থিত। এটি সেনাসদর থেকে পরিচালিত ‘ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশন-৩’ এর নিয়ন্ত্রণাধীন। রাজধানী সিথওয়েতে একটি ‘রিজিওনাল অপারেশন কমান্ড’ রয়েছে। এর কমান্ডার হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিও মিন লাট।

রাখাইনে তাতমাদোর তিনটি ‘মিলিটারি অপারেশন কমান্ড বা এমওসি (ডিভিশন)’ মোতায়েন রয়েছে। যুদ্ধের বাস্তবতায় একটি লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশনও (এলআইডি) আনা হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিভিশন বলা হলেও তাতমাদোর এমওসিগুলোর (১০টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন) সৈন্যবল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্রিগেডের প্রায় সমপর্যায়ের।

এমওসি-১৫ মোতায়েন রয়েছে উত্তর আরাকানের বুধিডং এলাকায়। এমওসি-৯ মোতায়েন রয়েছে চকউতো (উত্তর আরাকান ও চিন সীমান্তে) এলাকায়। উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই এমওসি-৯ এর সদর দফতর আরাকান আর্মি দখল করেছে। দক্ষিণ আরাকানের টংগপ অঞ্চলে নিয়োজিত রয়েছে এমওসি-৫।

প্রত্যেক এমওসিতে রয়েছে তিনটি করে ‘ট্যাকটিকাল অপারেশন কমান্ড বা টিওসি’ (ব্রিগেড)। প্রত্যেক টিওসির আওতায় কাজ করে তিনটি করে পদাতিক ব্যাটালিয়ন। উল্লেখ্য, তাতমাদোর পদাতিক ব্যাটালিয়নের বর্তমান জনবল ২০০-৩০০ এর মতো। বার্মাবিষয়ক গবেষক এনথনি ডেভিসের মতে বর্তমানে রাখাইনে তাতমাদোর সৈন্যবল কমপক্ষে ১৫ হাজার। গত ৪ মাসের যুদ্ধে তাতমাদোর জানমালের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি হয়েছে। এনথনি ডেভিস মনে করেন রাখাইন যুদ্ধক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সৈন্যবলও ১৫ হাজারের মতো।

সে ক্ষেত্রে আক্রমণকারী হিসেবে আরাকান আর্মির এই সৈন্যবল (১৫ হাজার) সুবিধাজনক অবস্থানের নয়। এদিকে তাতমাদোর আরও একটি সুবিধা হলো- অন্য রাজ্যের তুলনায় রাখাইন ইয়াঙ্গুনের অধিকতর নিকটবর্তী এবং যেখানে জল ও আকাশ পথে রসদ সামগ্রী পাঠানো সহজতর।

রাখাইনে অবস্থিত ‘ধ্যান্যাবাদী রিজিওনাল কমান্ড’ মিয়ানমারের পাঁচটি নেভাল রিজিওনাল কমান্ডের অন্যতম। এর রিজিওনাল কমান্ডার হলো কমোডর ট্রে নেইং। চকপিউতে রাখাইনের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনীর ঘাঁটি- ‘ধান্যবাদী নেভাল বেস’ অবস্থিত। সিথওয়েতে রয়েছে নির্মাণাধীন ‘শোয়েমিন গান’ নৌঘাঁটি। দক্ষিণ রাখাইনের থান্ডওয়েতে একটি ছোট নৌঘাঁটি রয়েছে। চকপিউতে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের কাছে একটি সাবমেরিন বেজ গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে আরাকান আর্মির আক্রমণে জান্তা নৌবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সিথওয়ে ও আন-এ রয়েছে তাতমাদোর সামরিক বিমানবন্দর। ম্যাগওয়ে শহরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি। এখান থেকেই রাখাইনে ফিক্সড উইং বিমানের (যেমন জঙ্গি বিমান) আক্রমণ পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে তাতমাদোর স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আক্রমণ পরিচালনা ও সরবরাহ ক্ষেত্রে বিমান বাহিনী (তাতমাদো লে) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তাতমাদোর সামরিক ডকট্রিন হলো- ‘আধুনিক সময়ে জনযুদ্ধ।’ তাতমাদো আরাকান আর্মির বিদ্রোহ মোকাবিলায় তাদের নিষ্ঠুর ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি’ কৌশল প্রয়োগ করছে। তাতমাদোর একটি কুখ্যাত কৌশল হলো- ‘ফোর কাট’ স্ট্র্যাটেজি। এর মাধ্যমে তারা যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে যোগাযোগ, খাদ্য, চিকিৎসাব্যবস্থা ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর ফলে রাখাইনের সাধারণ মানুষ চরম কষ্টের মধ্যে আছে। রাখাইন এখন প্রায় দুর্ভিক্ষের প্রান্তে।

বর্তমান ‘ব্যাটল ডিনামিক্সে’ অনেক কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। জান্তা বাহিনী বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিমান আক্রমণ ও আর্টিলারি আক্রমণ চালাচ্ছে। এতে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হতাহত, বাস্তুচ্যুত ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই যুদ্ধ এখন গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে সৈন্য প্রেরণ ও রসদপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে আকাশপথই এখন তাতমাদোর প্রধান ভরসা।

বর্তমানে মংডু, রাথেডং, বুথিডং ও সিথওয়ে শহরের আশপাশে প্রচ- যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের ভয়ে রাজ্যের রাজধানী সিথওয়ে বা আকিয়াব শহরের অধিকাংশ অধিবাসী শহর ছেড়ে পালিয়েছে। সিথওয়ের ‘সানপিয়া কোয়ার্টার’ এলাকায় মিন পেইং জিন রোডের নীল রঙের সুদৃশ্য ২ নম্বর বাড়িটি এখন বন্ধ। এটিই সিথওয়ের বাংলাদেশ কনসুলেট অফিস। নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশের কূটনীতিকগণ এখন সবাই রেঙ্গুনে। তাতমাদো এ প্রাদেশিক রাজধানী শহর রক্ষার জন্য ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে।

গত ১১ মার্চ রাখাইনের দক্ষিণে অবস্থিত রামরি শহরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি। এ শহরের নিকটবর্তী চকপিউতে চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ চলছে। চকপিউ থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত ১৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডোর চালু করেছে বেইজিং। যার মাধ্যমে চীন সরাসরি বঙ্গোপসাগর/ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এভাবে যুদ্ধ এখন অত্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চকপিউ অঞ্চলেও পৌঁছেছে। তবে সিথওয়ে ও চকপিউ অঞ্চল ধরে রাখার জন্য তাতমাদো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে বলে মনে করা হয়।

একেবারেই কোণঠাসা জান্তা-সরকার টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে বেশ কিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি গণচীনের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানির কারণে সরকার ১০ ফেব্রুয়ারি ঔপনিবেশিক আমলের কন্সক্রিপশন আইন বা বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরির বিষয়টি পুনরুজ্জীবিত করেছে। কিন্তু আইন করেও জান্তা সরকার আশানুরূপ ফল পায়নি।

রাখাইনে এখনো প্রায় সোয়া ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। জান্তা-সরকার অসহায় রোহিঙ্গাদের শেষমেশ দলে টানার চেষ্টা করছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, জান্তার হয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিলে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এভাবে তারা রণাঙ্গনে রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির মুখোমুখি করার ও মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অপকৌশল নিয়েছে। এদিকে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রোহিঙ্গারাও আরাকান আর্মিতে যোগ দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদার হলেও আরাকান আর্মি এখনো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।

আরাকান আর্মি এখন পর্যন্ত ১৮০টির বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। এখন উত্তর রাখাইনে যুদ্ধ চলছে টেকনাফ অঞ্চলের ওপারে। হারানো ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী দিনে তাতমাদো রাখাইনের আরাকান আর্মির অবস্থানের ওপর সর্বাত্মকভাবে আক্রমণ করতে পারে। বিশেষত যদি মিয়ানমারের অন্য ফ্রন্টে গেরিলাদের আক্রমণের গতি কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে, উত্তর ও মধ্য রাখাইনের যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। তখন ২০১৭ এর মতো রোহিঙ্গা ঢল, এমনকি রাখাইন ঢলও নামতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে মংডু, বুধিডং, সিথওয়ে ও চকপিউ এলাকার লড়াই অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী হতে পারে। এসব অঞ্চলে তাতমাদো নিজেদের রক্ষার জন্য ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে, বিশেষত বিমান, নৌ ও গোলন্দাজ শক্তির সাহায্যে। তাতমাদোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো, যুদ্ধ বিরতি ও শান্তি আলোচনা। তারা এক ফ্রন্টে যুদ্ধ বিরতি স্থাপন করে, অন্য ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পরিকল্পিতভাবে বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। রাখাইনের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এ বছরের মধ্যেই আরাকান আর্মির হাতে সমগ্র রাখাইনের পতন হবে। গত ১২ মার্চ ২০২৪ থেকে রাখাইনের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার ও রাখাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘থিনজিয়ান’ বা ‘সাংক্রান’ (জল উৎসব) অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে আগামী মে মাস থেকে মিয়ানমারে বর্ষা মৌসুম শুরু হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাতময় এ সময় বিশেষত মে-অক্টোবর উভয় বাহিনীর জন্যই যুদ্ধকে কঠিন করে ফেলবে। অর্থাৎ এই বছরের মে মাসের মধ্যে আরাকান আর্মি বৃহত্তর আভিযানিক অগ্রগতি অর্জন না করলে এ বছরটি হয়তো রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল ধরে রাখতে সক্ষম হবে তাতমাদো।

রাখাইনের পতন নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো হয়নি। রাখাইনকে তারা মোটেই সহজে ছেড়ে দেবে না। এ ছাড়াও চকপিউ অঞ্চলে চীনের মহাগুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের জন্য চীনের মধ্যস্থতায় এক ধরনের সমঝোতাও হতে পারে। আরাকান আর্মি বেশি থেকে বেশি অঞ্চল দখল করে নেগোসিয়েশনে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার চেষ্টা করবে। বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের আশ্বাসে শান রাজ্যের ওয়া স্টেটের মর্যাদায় আরাকান আর্মি কেন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতাও করতে পারে।

আরাকান আর্মি মুখপাত্র খিয়াং তু খা বলেছেন, ‘‘সম্পূর্ণ রাখাইন রাজ্য দখল নেওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব।” অন্যদিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্য হারানোর অর্থ হলো জান্তা সরকারের পরাজয় এবং নেপিদো শাসকদের পতন দ্রুততর হওয়া। কৌশলগত দিক দিয়ে রাখাইনে পরাজিত হলে পুরো গৃহযুদ্ধে তারা হেরে গেছে বলে প্রতীয়মান হবে। তাই তাতমাদো যে করেই হোক রাখাইনের অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ ধরে রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।

তাতমাদো অত্যন্ত শক্তিশালী, দক্ষ, কৌশলী ও চতুর একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় ধরে দেশ পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকায়, অতীতে বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তারা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আন্দোলন ম্যানেজ করেছে বা চরম নিষ্ঠুরভাবে তা প্রতিরোধ করেছে। তবুও যদি চলমান সব ফ্রন্টে গেরিলা দলগুলোর প্রচ- চাপ অব্যাহত থাকে তবে তারা বিপাকে পড়বে। হার্টল্যান্ডেও বামার জনগোষ্ঠীর ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ আক্রমণ অব্যাহত রাখে। একই সঙ্গে যদি চীন জান্তা সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে তবে এক বছরের মধ্যে আরাকান আর্মি সম্পূর্ণভাবে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হবে। যুদ্ধ শেষে শান্তি নামুক অপরূপ আরাকানে।

লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

bayezidsarwar792@gmail.com

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions