কক্সবাজার:- জেলার চকরিয়া ও বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং মৌজার সংরক্ষিত বন ও উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঘন বনজঙ্গলে গড়ে ওঠেছে ৩৬টি ইটভাটা। অথচ এক দশক আগেও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে সমৃদ্ধ এই পাহাড়গুলো।
শুধু তাই নয় কক্সবাজার-বান্দরবানের এসব বনাঞ্চল দিয়েই বন্যহাতির পাল চুনতি ও বাঁশখালীর অভয়ারণ্য হয়ে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল চষে বেড়াতো। কিন্তু এই কয়েক বছরেই চিরহরিৎ এই বনের অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে ৩৬টি অবৈধ ইটভাটা।
অধিকাংশ ভাটায় সংরক্ষিত বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে। অবশ্যই সেখানে ১২টি ভাটা কয়লাচালিত জিকজ্যাগ পদ্ধতিতে চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মালিকেরা।
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। এছাড়াও আইনে বলা আছে, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা করা যাবে না। ইট উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারেও নিষেধ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মৌজার প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার একর জমি নিয়ে লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়ন। এরপাশে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নে পড়েছে মৌজার একাংশ। দুই এলাকার সীমান্তেই বানানো হয়েছে বেশিরভাগ ভাটা। কোনো ভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স (অনুমোদন) নেই। কিন্তু দিব্যি বছরের পর বছর ভাটাগুলো সংশ্লিষ্টদের হাত করেই চালানো হচ্ছে।
কক্সবাজার শহর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে ৬২ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার বানিয়ারছড়া স্টেশন। এখান থেকে পূর্ব দিকে গেছে পিচঢালা ফাইতং সড়ক। এ সড়কে পা ফেলতেই বোঝা যায় ছোট এই সড়ক যান চলাচলের কতটা ব্যস্ত। মাত্র ১৫ মিনিটেই আসা-যাওয়া করতে দেখা গেল, ছোট-বড় ৩০টি ডাম্প ট্রাক ও পিকআপ। কোনো ট্রাক ইটবোঝাই করে বের হচ্ছে আবার কোনো ট্রাক খালি কিংবা জ্বালানি কাঠ নিয়ে ভেতরে ঢুকছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, ফাইতং ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৫০০-৬০০ একর জায়গায় রয়েছে ২৮টি ইটভাটা। চারটি ভাটা পড়েছে চকরিয়ার ফাইতং এলাকায়। ফাইতং সড়কের ছয় কিলোমিটার এলাকায় চকরিয়ার লক্ষ্যারচরের ফরিদুল আলমের এফএসি নামের ইটভাটা। প্রায় ১০ একরের মতো পাহাড় কেটে এই ভাটায় বসানো হয়েছে ইট পুড়ানোর চিমনি। পাশেই এস্কেভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়কাটা মাটি ভিজিয়ে কাঁচা ইট বানাতে ব্যস্ত ২৫-৩০ জন শ্রমিক। চিমনির চুলার আশপাশে পুড়ানোর জন্য মজুদ রাখা হয়েছে কাঠের স্তূপ। সংরক্ষিত বন থেকেই এসব কাঠ ভাটায় আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইটপ্রস্তুতে ভাটার অনুমোদন আছে কি-না জানতে চাইলে ভাটাটির ব্যবস্থাপক পরিচয়ে এক যুবক এ বিষয়ে কিছু জানার থাকলে ভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। ভাটার কাগজপত্র সংক্রান্ত ও দাপ্তরিক কাজ সমিতির নেতারা দেখভাল করেন বলে জানান ওই যুবক।
একটি ভাটার মালিক মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিমুল হক। তিনি বলেন, সরকারি নীতিমালা মেনে ১২টি ভাটা আমরা জিকজ্যাগ পদ্ধতিতে স্থাপন করেছি। এসব ভাটা সম্পূর্ণ কয়লাভিত্তিক। কিন্তু পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ইটভাটা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণে লাইসেন্স আটকে আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়েছি। পার্বত্য এলাকায় কিছু শর্তও শিথিল করার আবেদন করেছি।
ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার আহমদ দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করছেন জানিয়ে বলেন, সব ভাটার অনুকূলে আয়কর, ভ্যাট ও ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। তারপরও সবাইকে হাত করেই ভাটা চালাতে হয়। এছাড়া প্রতিবছর ভাটাগুলোয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করছে।
যোগাযোগ করা হলে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, নিয়ম না মেনে ভাটা পরিচালনার অভিযোগে গত মার্চ মাসে ফাইতংয়ের কয়েকটি ভাটাকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে কিছু ভাটা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারে ৮৭ ভাটার ৪৬টির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই
কক্সবাজারের নয় উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেব মতে ৮৭টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে ৪১ ভাটাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৬টির নেই পরিবেশ ছাড়পত্র।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের হালনাগাদ তথ্যে, ৫৩টি ভাটার তালিকা পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ২৫টি ভাটার লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে, মেয়াদোর্ত্তীণ রয়েছে ১৬টি ভাটার। চকরিয়ার একটি ভাটা বন্ধ আছে। ১০টি ভাটার মালিক লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছে জেলা প্রশাসকের কাছে।
জেলা প্রশাসনের তালিকা মতে ২৯টি ভাটা রয়েছে রামু উপজেলায়। সরেজমিন দেখা গেছে, এসব ভাটাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লোকালয় ও বনের আশপাশে আইন না মেনে স্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী ভাটা মালিকরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ভাটা চালিয়ে আসছেন।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, জেলায় ৮৭টি ইটভাটা চালু আছে। এরমধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৪১টিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ভাটা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রামু এবং ঈদগাঁও উপজেলায় অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এরমধ্যে রামুর ধোঁয়াপালং এলাকায় এসবিএম ব্রিকস নামের একটি ভাটার চুল্লি ধ্বংস করা এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একইদিনে রামুর খুনিয়াপালং, মেরংলোয়া ও ধোঁয়াপালং এলাকায় আরও পাঁচটি ভাটাকে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বাংলানিউজকে বলেন, লোকবল ও অর্থ সংকটের কারণে ভাটা উচ্ছেদে বড় অভিযান সম্ভব হচ্ছে না। তালিকা হালনাগাদ করে অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভাটা উচ্ছেদ চায় বনবিভাগ
কক্সবাজারে কুতুবদিয়া দ্বীপ ছাড়া আট উপজেলা পাহাড় ও নদী বেষ্টিত। কক্সবাজারে বনবিভাগের দুটি অঞ্চল উত্তর ও দক্ষিণ। উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন সদর, রামু, ঈদগাঁ, চকরিয়া ও পেকুয়ার সংরক্ষিত বনের আশপাশেই রয়েছে ৩৪টি ইটভাটা। পাশের ফাইতং মৌজার ২৮টি ভাটাও পড়েছে এই বনের কাছে। দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় রয়েছে ১২টি। বনের ওপর চাপ কমাতে এসব ভাটা বন্ধ বা উচ্ছেদের জন্য বনবিভাগ লিখিত ও মৌখিকভাবে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে আসছে বলে জানান কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সরওয়ার আলম।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, সংরক্ষিত বনের পাশের ভাটাগুলো বন্ধে বিভিন্ন সময়ে বনবিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বনের কাঠ পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ করতে বনকর্মীরা সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রয়েছে।বাংলানিউজ