ডেস্ক রির্পোট:- সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবন (বাণিজ্য ও স্বাস্থ্য)। ২৯ নম্বর কক্ষ। দুপুর ১২টা। দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের শুনানির জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাদী সৈয়দ জাহেদ হোসেইন। গতকাল ছিল দ্বিতীয় শুনানির তারিখ। দুপুর ১টায় শুনানি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিটের দিকে শুনানি শুরু হয়। বিকাল ৪টায় শেষ হয়। শুনানি কক্ষে উপস্থিত ছিলেন তদন্ত কমিটির সভাপতি নার্সিং শিক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব আব্দুল কাদের, নার্সিং শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সদস্য সচিব ডা. জাহিদুর রহমান, অভিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েস এবং অভিযোগকারী (বাদী) সৈয়দ জাহেদ হোসেইন। গত ২৮শে মার্চ প্রথম শুনানি হয়। প্রথম দিনে ২ ঘণ্টা শুনানি হয়।
এর আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েসকে নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠায় ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত বিস্তর অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদে প্রবেশ না করেন মৌখিকভাবে তাকে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠছে বরখাস্ত হওয়ার পর ‘কৌশলী’ ইমরুল কায়েস অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কম্পিউটার অপারেটরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে অভিযোগকারী বাদী সৈয়দ জাহেদ হোসেইনকে আপসের প্রস্তাব করছেন। এবার তিনি টাকার অঙ্ক বাড়িয়েছেন। ঘুষের ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ফেরত তো বটেই সঙ্গে আরও প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার- মোট ৮ লাখ টাকা প্রদানের প্রস্তাব করেছেন। এটাকে ‘ফাঁদ’ ভেবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন জানিয়ে বাদী বলেন, তিনি আমাকে বহুভাবে কাবু করার চেষ্টা করছেন। আমি তাতে কান দিচ্ছি না। কারণ এখন বিষয়টি যে পর্যায়ে আছে তাতে সরকারের কাছ থেকে আমি ন্যায়বিচার পাবো বলে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। আর এতে বিবাদী ইমরুল নানা ফাঁদ পেতে চলেছেন! তদন্ত কমিটির এক সদস্যদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় তিনি যত্রতত্র আমাকে ভর্ৎসনা করাসহ জীবননাশের হুমকি প্রদান করছেন। ভুক্তভোগী সৈয়দ জাহেদ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে গত ২৮শে মার্চ মন্ত্রণালয়ে একটি একটি লিখিত আবেদন দায়ের করেন। তাতে তদন্ত কমিটিতে থাকা বিবাদীর ঘনিষ্ঠজন বলে খ্যাত রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সদস্য সচিব ডা. জাহিদুর রহমানকে তদন্ত কমিটি থেকে বাদ দেয়ার জোর আর্জি জানান।
এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রমাণ মানবজমিনের কাছে রয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাদী সৈয়দ জাহেদ হোসেইন গতকাল বলেন, আমি একটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ইমরুল কায়েসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বিদেশে থাকা অবস্থায় পরামর্শ নেই। যেহেতু প্রায় ১৮ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত আমি দেশের বাইরে ছিলাম। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি বাংলাদেশে আসি। ২০২৩ সালে আমার পরিচিতদের একজন ইমরুল কায়েসের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর বলেন, এটা কোনো বিষয় না। আমার নিজের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। আপনাকে আমি নার্সিং কলেজের নিবন্ধন নিয়ে দেবো।
এজন্য আপনার ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। তাকে জানাই সমস্যা হবে না। আমি অনুমোদন চাই। গত বছরের ৩০শে এপ্রিল তোপখানা রোডের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে আমার এক আত্মীয়সহ টাকা তুলে প্রাথমিকভাবে তাকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা একটি সাদা খামে দেই। এরমধ্যে ৭০ হাজার টাকা ছিল তার পরিদর্শন খরচ। আর ৪ লাখ টাকা তিনি ঘুষ হিসেবে নিবেন। তার নিজ কক্ষে টাকাভর্তি সাদা খামটি তার ডেস্কের নিচে রেখেছেন। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করলে এটা দেখা যাবে যদি তিনি ফুটেজ গায়েব না করে থাকেন। টাকাটা নেয়ার পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেন না। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার পর তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাফিজুল, মিজবাহ, ইমরুলের শিক্ষার্থী খন্দকার মনির হোসেন এরা তিনজন মিলে হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ করে আমাকে আপসের প্রস্তাব দেন। আমি কোনোভাবে আপস না করে কথোপকথনের স্ক্রিনশট নেই। এটা পরে তদন্ত কমিটিকে দেখিয়ে জানাই, তারা যদি ঘুষ না নিয়ে থাকেন তাহলে আপসের চেষ্টা করছেন কেন? এটাই বড় প্রমাণ। বাদী জাহেদ বলেন, টাকা দেয়ার পর ফোন দিলে তিনি রিসিভ করতেন না। অধিদপ্তরের অফিসে গেলে আমাকে এড়িয়ে চলতেন। প্রথমবার আমার নার্সিং কলেজ ভিজিট করার পর অনুমতি দেয়া হবে না? এসব কিছু না জানিয়ে সেটা ঝুলিয়ে রাখা হয়। একপর্যায়ে আমি হতাশ হয়ে ইমরুল কায়েসকে ফোন দিয়ে বলি, ভিজিট এর ফলাফল নেগেটিভ আসছে আপনি আমার টাকাটা ফেরত দেন। এ সময় তিনি কিছু না বললে আমার পরিচিত একজনকে দিয়ে তাকে ফোন দেই।
তখন ইমরুল বলেন, আমি তাকে চিনি না। আমার ওই আত্মীয় এক সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিষয়টি জানালে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকে তিনি তার বিভিন্ন কর্মচারীদের দিয়ে আমাকে বিভিন্ন সময় ফোন দিয়ে আপস মীমাংসার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এখন বলছেন- যে টাকা নিয়েছেন তার দ্বিগুণ টাকা অর্থাৎ ৮ লাখ টাকা ফেরত দিবেন! বাদী বলেন, এখন আর আমি আপস চাই না। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই মেনে নেবো। আমার একটাই কথা, আমি এটার শেষ দেখতে চাই। বাদী সৈয়দ জাহেদ বলেন, গত ২৭শে মার্চ সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের ১৯ নম্বর কক্ষে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আমি তাদেরকে একটি লিখিত আর্জি (আবেদন) জানাই। যেখানে আমি তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ডা. জাহিদুর রহমানের সঙ্গে অভিযুক্ত ইমরুল কায়েসের সখ্যতার প্রমাণপত্র হাজির করেছি। তদন্ত কমিটি এটা আমলে না নিয়ে তাদের মতো করে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।
বাদী বলেন, ২৭শে মার্চ প্রথম শুনানি শেষে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অভিযুক্ত ইমরুল কায়েস আর তদন্ত কমিটির সদস্য ডা. জাহিদুর রহমানকে খোশগল্প করতে দেখি। তারা একসঙ্গেই স্থান ত্যাগ করেন। আমি পুনরায় আরেকটি আবেদন করি। যেখানে বলা হয় তদন্ত কমিটির দু’জন সদস্যের সঙ্গে ইতিমধ্যে ইমরুল কায়েসের ভালো সম্পর্ক থাকলে কীভাবে তদন্ত কার্যক্রম সুষ্ঠু হবে? এবারো তদন্ত কমিটি আমার অভিযোগ আমলে নেয়নি। গতকালও একইভাবে দ্বিতীয় শুনানিতে আমাদের বাদী-বিবাদীকে ডাকা হয়। আমার পক্ষের যিনি সাক্ষী তিনি বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় হাজির হতে পারেননি। তিনি একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এতে বলা হয়, তিনি চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন। ফোন ট্রায়ালের মাধ্যমে তার সাক্ষী নিতে চাইলে তিনি সেটা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। তদন্ত কমিটির সভাপতি গ্রহীত হলো লিখে রেখে দিয়েছেন।
আজকের শুনানিতে, তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, যদি আমার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে তিন মাসের জেল হতে পারে। আমি এ বিষয়ে প্রস্তুত আছি কিনা? উত্তরে আমি জানাই, অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে আমি তিন মাসের জেলের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি। শুনানির একপর্যায়ে জানতে চাওয়া হয়, অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে অপরাধীর সর্বোচ্চ কি শাস্তি আশা করেন? জবাবে জানাই- দেশের প্রচলিত আইনে যে শাস্তি হবে আমি তাতেই সন্তুষ্ট।মানবজমিন