শিরোনাম
রাঙ্গামাটির কাঁচালং নদীতে নিখোঁজ শিক্ষার্থী জয়ন্তী চাকমার ১৬ ঘণ্টা পর মরদেহ উদ্ধার রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে পুলিশের অভিযানে ৩০ লিটার দেশীয় মদ ও সিএনজিসহ আটক ৩ চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুদুক কর্মকর্তার মৃত্যু: আসামির ৩ দিনের রিমান্ড তীব্র গরমের মধ্যেই খুলল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অসন্তুষ্ট অভিভাবকরা নাইজেরিয়ায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে জিহাদি বিরোধী ১১ মিলিশিয়া যোদ্ধা নিহত যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নজিরবিহীন বিক্ষোভ : ‘ইসরায়েলনীতি বদলাতে হবে’ যাত্রাবাড়ীতে গরমে অসুস্থ হয়ে অটোরিকশাযাত্রীর মৃত্যু ‘হিটস্ট্রোকে’ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যু, স্থগিত নির্বাচন চট্টগ্রামে হিটস্ট্রোকে প্রাণ গেল শিক্ষকের বান্দরবানে ধর্মঘটে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে যাত্রীরা

বিডিআর বিদ্রোহ : এস এম আব্রাহাম লিংকনের একটি সাহসী কাজের কথা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪
  • ৮৩ দেখা হয়েছে

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) জি এম কামরুল ইসলাম:- ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা কমবেশি সবারই মনে আছে। সে সময় আমি রংপুরের একটি পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলাম। তখন রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট আমাদের দায়িত্বে ছিল।

পিলখানার পরে রংপুর ও কুড়িগ্রামেও বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়েছিল। সে সময় কুড়িগ্রামের ২৭ রাইফেলস ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুমন কুমার বড়ুয়া (পরে কর্নেল ও বিজিবির পরিচালক প্রশাসন)। তার সঙ্গে ছিল টুআইসি মেজর আলতাফুল কবির, অপারেশনস অফিসার মেজর কামাল, ক্যাপ্টেন ডা. ইদি আমিন। ঘটনার সময় একটি ট্রেনিংয়ে ক্যাপ্টেন ইদি আমিন কুড়িগ্রামের বাইরে ছিলেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার নারকীয় ঘটনার পরেই কুড়িগ্রামে বিডিআরের কিছু জওয়ান অধিনায়ক কর্নেল সুমনসহ সেনা কর্মকর্তাদের টেলিফোন অপারেটর রুমে আটক করে। সকল ধরনের যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয় জওয়ানরা। কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে তারা। একই সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যরাও আটকা পড়ে।

একই তারিখে কুড়িগ্রামের সীমান্তগুলোর বিওপি থেকে কোম্পানি কমান্ডাররা কুড়িগ্রাম ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে চলে আসে। ডিএডিকে অধিনায়ক ঘোষণা করে বিদ্রোহীরা। বিডিআরের কিছু সদস্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক বক্তব্য প্রদান ও অবস্থান নিয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে সমরাস্ত্র জওয়ানদের সরবরাহ করে। তারা কুড়িগ্রাম কলেজের ছাত্রাবাসসহ বিডিআর ক্যাম্পের বহুতল ভবনের ছাদগুলোতেও ভারী অস্ত্র বসায়।

রংপুর সেনানিবাস থেকে আর্মি আসছে এই মিথ্যাপ্রচার করে তারা অস্ত্রাগার ভেঙে নিজেদের সশস্ত্র করেছিল। তারা বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি করে ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে সরে যেতে বাধ্য করে। ফলশ্রুতিতে ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টারের নিকটবর্তী জজকোর্ট, ডিসি অফিস, আশপাশের কলেজ ও স্কুলগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। আদালতের বিচারক ও আইনজীবীরা কর্মস্থল থেকে সরে যান। ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কুড়িগ্রাম শহরে থমথমে অবস্থা তৈরি হয়।

ঢাকায় যখন রক্তাক্ত পরিস্থিতি তখন কুড়িগ্রামে বিডিআর ক্যাম্পে আটক সেনা কর্মকর্তারা বেঁচে আছে কিনা আমরা জানতে পারছিলাম না। যদি বেঁচে থাকেও তাহলে কোথায় আছে, কেমন আছে সবকিছুই আমাদের কাছে অজানা ছিল। ব্যাটলিয়নে গোলাগুলির খবরে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে বিদ্রোহীরা অফিসারদের হত্যা করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাও ভেতরের সঠিক খবর দিতে পারছিল না। জেলার সিভিল প্রশাসনের লোকজনও অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। পুলিশ প্রশাসনও তেমন কিছু করতে ও বলতে পারছিল না।

এ অবস্থায় রংপুর সেনানিবাস থেকে আমি কুড়িগ্রামের আইনজীবী আমার বড় ভাই এনায়েত হোসেনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ ও রাজনৈতিক সহকর্মী আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে কথা বলি। আব্রাহাম লিংকন এবং কর্নেল সুমন বড়ুয়া তারামন বিবির (বীরপ্রতীক) বাড়ি নির্মাণের জন্য গঠিত কমিটির সদস্যসচিব ও আহ্বায়ক ছিলেন। যে কাজে অনেক বিডিআরের সদস্য আব্রাহাম লিংকনকে নানাভাবে সহায়তা করেছিল।

আব্রাহাম লিংকনের সন্তান কুড়িগ্রামে রাইফেলস স্কুলে প্রাথমিকে পড়ত। সে সূত্রে তিনি স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিরও সহসভাপতি ছিলেন। যেখানে বিডিআর সদস্যদের সন্তানরাও পড়াশোনা করত। এসব কারণে ডিএডিসহ বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। পিপি হওয়ার কারণে আদালত সংশ্লিষ্ট কাজে বিডিআর সদস্যরা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এসব আমার জানা ছিল। সে জানা থেকেই আব্রাহাম লিংকনকে অনুরোধ করি তিনি বিষয়টি সমাধানে আমাদের যেন সাহায্য করেন। তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পেশাকে ব্যবহার করে তিনি যেন প্রকৃত খবরটি আমাদের জানান।

তা ছাড়া সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারগুলোকে উদ্ধারের জন্যে অনুরোধ করি। তিনি শুধু জানতে চেয়েছিলেন সেনা অফিসারদের উদ্ধারে কুড়িগ্রামে আর্মির কোনো অভিযান হবে কিনা। তাকে নিশ্চিত করি এধরনের পরিকল্পনা নেই। এরপর তিনি কাজে নেমে পড়েন। মনে পড়ে একজন ওয়ারেন্ট অফিসারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন। তার কাছ থেকে নিশ্চিত হই যে কর্নেল সুমন বড়ুয়াসহ সেনা কর্মকর্তারা বেঁচে আছেন। আব্রাহাম লিংকনকে বলি আপনি যেহেতু সূত্র বের করতে পেরেছেন বাকিটুকুও পারবেন। তিনি আমাদের অনুরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে তিনি কোম্পানি কমান্ডারদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে প্রথমে পরিবারগুলোকে উদ্ধার করে নিজের বাসায় রাখেন। পরিবারগুলোর সঙ্গে আমাকে কথাও বলিয়ে দেন।

এরপর আব্রাহাম লিংকন নতুন করে উদ্যোগী হন অফিসারদের বের করে আনার কাজে। আব্রাহাম লিংকন সাহেব তাদের নিশ্চিত করেন সেনাবাহিনীর কোনো অভিযান হবে না এবং প্রস্তাব করেন ‘অফিসারদের অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি’ এই রকম একটা লিখিত দেবেন। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসককে সঙ্গে এনে তাদেরকে নিয়ে যাবেন। বিডিআরের সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডাররা লিখিত কাগজ দেওয়া এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হস্তান্তরের বিষয়টিতে তারা রাজি হলে তিনি লিখিত জিম্মানামা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে যান।

সেখান থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৭টার পর লিখিত মুচলেকা দিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্ধার করে আনেন। তিনি লিখিত জিম্মানামার রিসিভ কপিতে ডিএডি ময়শের আলীর স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন। উদ্ধারের রাতেই পরিবারসহ অফিসারদের তিনি রংপুর সেনানিবাসে পৌঁছে দেন। আমরা তাকে ও অফিসারদের রিসিভ করি। ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে জওয়ানদের অস্ত্রাগার ভেঙে নেওয়া অস্ত্র উদ্ধারেও সহায়তা করেন আব্রাহাম লিংকন।

স্থানীয় প্রশাসন যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও ভীতসন্ত্রস্ত। অনেকেই যখন সেনানবাহিনী ও সরকারের দোষ ত্রুটি খোঁজা আর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে ব্যস্ত তখন আব্রাহাম লিংকন একজন সাধারণ নাগরিক হয়েও আমাদের অনুরোধে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে একাই আলোচনার মাধ্যমে শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি নাটকের রক্তপাতহীন অবসান ঘটিয়ে সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারকে উদ্ধার করেছিলেন। আজকে মনে হয় স্বপ্নের মতো কিন্ত সেদিন এটিই ছিল বাস্তব ও সত্যি। ফলশ্রুতিতে বিডিআর ক্যারেনেজের মামলায় তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতাও ছিলেন।

তখন আমরা তাকে তেমনভাবে সম্মানিত করিনি। তবে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আমরা একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছিলাম। তা ছাড়া তিনি রংপুরে সেনাবাহিনী পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর ‘শাশ্বত বাংলা’ এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মারকও আমাদের জোগাড় করে দিয়েছিলেন।

অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন একজন তৃণমূল পর্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী ও পরোপকারী মানুষ। কুড়িগ্রামে নিজের বাড়িতে প্রায় একক চেষ্টা, অর্থ ও শ্রমে অনন্য সুন্দর উত্তরবঙ্গ জাদুঘর নামে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ করে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সুবক্তা এবং লেখকও বটে তিনি। আমার জানা মতে ফেলানী হত্যা মামলায়ও গঠনমূলক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ও ভারসাম্যমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় যাত্রীর অধিকার সংরক্ষণে এবং স্কোয়াশ খেলার প্রচলনে আমাকে নানাভাবে সহযোগিতাও করেছেন।

একজন মানুষ পুরস্কারের জন্য কাজ করেন না, আব্রাহাম লিংকনের মতো মানুষও করেননি। পুরস্কার নিয়ে আজকাল নানা কথামালা চোখে পড়ে যা পুরস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এরকম এক সংকটকালে স্বাধীনতা পুরস্কারে এস এম আব্রাহাম লিংকনকে মনোনয়ন প্রদানে শুধু তাকেই সম্মানিত করা হলো না বরং পুরস্কারটিও মর্যাদায় ফিরল বলে বিশ্বাস করি।

সঙ্গতকারণে টেলিভিশনের স্ক্রলসহ যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার মনোনয়ন দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছি। রাষ্ট্রের বিপদে যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অফিসারদের উদ্ধার করেছেন রাষ্ট্র তাকে দলমতের ঊর্ধ্বে যথার্থভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন। এই মনোনয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) জি এম কামরুল ইসলাম : সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions