ডেস্ক রির্পোট:- প্রায়ই শোনা যায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গিয়ে নিখোঁজ বা মৃতদের তালিকায় আছে বাংলাদেশিদের নাম। অবৈধ পথে ইউরোপে গিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত পাওয়ার আশায় অবর্ণনীয় পরিস্থিতি ও নির্মম নির্যাতনের শিকারই শুধু নয়, জীবন ঝুঁকিতে ফেলছেন বাংলাদেশি তরুণরা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য বলছে, শুধু গত বছরই (২০২৩) প্রায় ১৩ হাজার বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছেছেন। এর আগে ২০২২ সালে সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের তিনটি জেলা থেকে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। নতুন করে মানবপাচারের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর জেলা। এগুলোতে নজর রাখার পাশাপাশি যেসব জেলায় মানবপাচার আইনে অতিরিক্ত মামলা আছে, সেসব জেলায় আরও বেশি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করার কথা ভাবছে সরকার।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপ যাত্রাকালে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকায় আগুন লেগে মারা যান ৮ বাংলাদেশি। ওই নৌকা থেকে ২৭ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। নিহত ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা বলে জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূল থেকে এক অপ্রাপ্তবয়স্কসহ ৩০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে ফরাসি দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) উদ্ধারকারী জাহাজ জিও ব্যারেন্টস। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ থেকে প্লেনে বাহরাইন ও ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি পৌঁছান তারা। সমুদ্রযাত্রার আগে মানবপাচারের দালালদের কাছে তিন-চার দিন বন্দি থাকতে হয়। খাবার ও পানির কষ্ট ছাড়াও সইতে হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন।
ইউরোপ পৌঁছে যাওয়া বা বিভিন্ন সময় নৌকা থেকে উদ্ধার পাওয়া অনেকেই নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের তথ্য
জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইসিআর-এর ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫১ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন ইতালি প্রবেশের উদ্দেশ্যে। এ সময়ে নিখোঁজ কিংবা মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৯৭টি, যা ২০১৮ সালের পর সর্বোচ্চ। সাগরপাড়ি দেওয়াদের এ দলের মধ্যে বাংলাদেশি আছেন ১২ হাজার ৭৭৪ জন— যা বাংলাদেশকে চতুর্থ অবস্থানে রেখেছে। এর আগে ২০২২ সালে সমুদ্র পথে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন ১৪ হাজার ৯৭১ জন বাংলাদেশি।
সংস্থাটির দেওয়া গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি ইতালি গেছেন ভূমধ্যসাগর দিয়ে।
অপরদিকে ইউরোপের দেশগুলোতে সমুদ্রপথে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮০ জন এবং এসময় নিখোঁজ কিংবা মারা গেছেন ৩ হাজার ৭৬০ জন। এর মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সমুদ্র কিংবা সড়কপথে গ্রিস এবং স্পেনে বাংলাদেশিদের প্রবেশের সংখ্যা খুবই কম। তাই এর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
ইউএনএইচসিআর বলছে, লিবিয়া থেকে যারা সাগরপথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন— তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ, মিশর ও সিরিয়ার নাগরিক।
গত ডিসেম্বরে স্লোভেনিয়ার সঙ্গে ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় প্রায় ১ হাজার ৩০০ জনকে আটক করা হয়। ২০২৩ সালে এই এলাকা দিয়ে ১২ হাজারের বেশি লোকের অনুপ্রবেশের তথ্য জানায় ইউএনএইচসিআর। এদের মধ্যেও অনেকে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক।
পাচারকারীদের পছন্দ নৌপথ
ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাতটি রুট ব্যবহার করা হয়। এর সবগুলোই লিবিয়া কিংবা তুরস্ক থেকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য। এ সাত রুটের মধ্যে ‘জনপ্রিয়’ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুটটি। এটি ব্যবহার করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়াকে ‘নিরাপদ’ মনে করে অনিয়মিত অভিবাসীরা। তাই দালালের কথায় প্রভাবিত হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলে যান লিবিয়া কিংবা তুরস্ক। সেখান থেকে শুরু হয় ইউরোপ যাওয়ার মূল পর্ব। ইউরোপ যেতে মোট খরচ হিসাবে চাওয়া হয় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। সেই টাকা আদায় করা হয় আগেই, এমনকি যাত্রা শুরুর পর শারীরিক নির্যাতন করেও টাকা আদায় করা হয়।
দেশের তিন জেলা মানবপাচারের ‘হটস্পট’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সিকিউরিটি ডিভিশনের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং এর ২০২৩-২৫ সালের কর্মপরিকল্পনার হালনাগাদ প্রতিবেদনে গত ৩১ ডিসেম্বর জানানো হয়— দেশের তিনটি জেলা মানবপাচারের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। জেলা তিনটি হচ্ছে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর।
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এখনও পর্যন্ত দেশের থানাগুলোতে ৮৮৪টি মামলা রুজু হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া মামলা পেন্ডিং আছে ৩ হাজার ৭০৪টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার। যেসব জেলায় বেশি সংখ্যক মানবপাচার মামলা আছে, সেখানে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করার কথাও বলা হয়েছে সরকারের গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনায়।
সরকারে উদ্যোগে দেশে মানবপাচারের ওপর করা প্রথম জাতীয় গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। এতে বলা হয়, সারা দেশে আদালত ও পুলিশের কাছে মানবপাচারের বিপুল সংখ্যক মামলা দায়ের করা হয়। ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন (পিএসএইচটিএ) এবং সাতটি বিভাগে প্রতিষ্ঠিত মানবপাচার-বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের পরিধি প্রসারিত করেছে। তারপরও মামলা চূড়ান্ত করা ও সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কেন কমছে না মানবপাচার
মাদক ও অপরাধ বিষয়ক জাতিসংঘের কার্যালয় (ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম বা ইউএনওডিসি) তাদের ২০২০ সালের গ্লোবাল রিপোর্ট অন ট্রাফিকিং-এ জানায়, অর্থনৈতিক চাহিদার কারণে বাংলাদেশে মানবপাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ২০১০ এর দশকের শেষের দিকে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস করেছে, এরপরও গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক লোক সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ ও দারিদ্র্য সীমার ভেতরেই রয়ে গেছে।
এই রিপোর্টে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আয়-উপার্জনের ভালো সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের পাচারকারীরা প্রলুব্ধ করে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, ‘অভিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়াও দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। তারা কেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছেন, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব দালাল লিবিয়া, তুরস্ক ও দুবাইয়ের ট্রানজিট পয়েন্টে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনে সেসব দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈধভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে গেলে বিদেশে যেমন সম্মানজনক ভালো বেতনের সুযোগ আছে, তেমনই নিজের জীবনেরও নিরাপত্তা থাকবে— এ বিষয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বোঝাতে হবে ‘
অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি আছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তার মতে, মানবপাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ের ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং জাতিসংঘের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমান জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় প্রত্যেক ভুক্তভোগীর কাছে সহায়তা পৌঁছানোর এবং প্রতিটি অপরাধীকে জবাবদিহির আওতায় আনারও চেষ্টা করছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, মানবপাচারের জঘন্য অপরাধ দেশের ভেতরে ও বাইরে নারী, পুরুষ ও শিশুকে বিভিন্ন ধরনের শোষণে আটকে রেখেছে। বর্তমান এনপিএ এই কারণগুলো মোকাবিলায় বিশেষ জোর দিয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সব ধরনের মানবপাচার রোধে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, মানুষ যাতে অবৈধ পথে ইউরোপে না যায়, সে জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি। সবার প্রতি অনুরোধ— অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি জমানোর চেষ্টা করবেন না। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বাংলা ট্রিবিউন