ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে যেভাবে ২০ জনকে হত্যা করেছিলেন ফুলন দেবী

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ২৩৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর; বেহমাই গ্রামে ১৯৮১ সালে হওয়া ওই হত্যাকাণ্ড এতটাই আলোড়ন তুলেছিল, ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘দস্যুরানী’ ফুলন দেবীর নাম। ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে ২২ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলেন তিনি। ফুলন দেবী জনমানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পান। বলা হতো, ফুলন দেবী তার লক্ষ্যে যতটা দৃঢ়, তার হৃদয় তার চেয়েও বেশি কঠোর।

ফুলন দেবী ১৯৬৩ সালে ভারতের এক নিম্ন বর্ণের হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবার বয়সী এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দারিদ্র্য এবং সামাজিক কারণে জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রামের মুখোমুখি হন তিনি। স্বামীর কাছে ফুলন দেবী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

অত্যাচারের মুখে শিশু ফুলন দেবী বেশ কয়েকবার স্বামীর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে এলেও সামাজিক চাপের মুখে বারবার তাকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৭৯ সালে জমি দখল নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে চাচাতো ভাইকে পাথর ছুঁড়ে আহত করেন কিশোরী ফুলন দেবী। এই ঘটনার পর স্থানীয় থানা পুলিশ তাকে প্রায় এক মাসের জন্য হাজত খানায় আটক করে রাখে। কারাগারে পুলিশের হাতে ধর্ষনের শিকার হন ফুলন দেবী। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে পরিবার ও গ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ওই বছরের জুলাই মাসেই বাবার বাড়ি থেকে স্থানীয় এক ডাকাত দলের হাতে অপহৃত হন ফুলন দেবী। ফুলন দেবীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় ডাকাত সর্দার বাবু গুজ্জর। ফুলন দেবীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাবু গুজ্জর তাকে টানা তিন দিন ধর্ষণ করে। তবে দলের আরেক ডাকাত বিক্রম মাল্লার সহায়তায় রক্ষা পান ফুলন দেবী। স্বজাতির ওপর বাবু গুজ্জরের এই নির্মমতা সহ্য করতে পারেননি বিক্রম মাল্লা।

ফুলন দেবীকে অপহরণের তিন দিনের মধ্যেই বাবু গুজ্জরকে খুন করে দলের নেতা হয় বিক্রম মাল্লা। বিক্রম ফুলন দেবীকেও অস্ত্র চালানো শেখায় এবং ডাকাত দলের সদস্য করে নেয়। বিক্রম মাল্লা ও ফুলন দেবী লুণ্ঠিত সম্পত্তি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেন। ভালোবেসে দুজন দুজনকে স্বামী-স্ত্রীর মর্যাদা দেন।

পরের প্রায় এক বছর তাদের ডাকাত দল উত্তর প্রদেশের দেভারিয়া, কানপুর আর ওরাই অঞ্চলে ত্রাস সঞ্চার করে। ফুলন তার প্রথম স্বামী পুত্তিলালের বসবাসকৃত গ্রামে লুণ্ঠন করেন। তিনি পুত্তিলালকে টেনে নিয়ে এসে জনসমক্ষে শাস্তি দেন ও খচ্চরের পিঠে উল্টো করে বসিয়ে ব্যাপক মারধর করেন। প্রায় মৃত অবস্থায় পুত্তিলালকে ফেলে চলে যায় ডাকাত দল। যাওয়ার সময় কম বয়সের বালিকা মেয়ে বিবাহ করা পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী স্বরূপ একটি পত্র রেখে যান ফুলন দেবী।

ফুলন উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ বসবাসকারী উচ্চবর্ণের লোকদের গ্রামে লুণ্ঠন, ভূস্বামীদের অপহরণ, রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযান চালিয়েছিলেন। সেসব এলাকার নিম্নবর্ণের ও দরিদ্র হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ফুলন দেবী। সেখানকার মানুষের মধ্যে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘দস্যু সুন্দরী’ হিসেবে। তবে ডাকাত দলের হাজতফেরত এক সদস্যের হাতে বিক্রম মাল্লার মৃত্যু ঘটলে ফুলন দেবীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় কানপুরের কাছে বেহমাই গ্রামে।

তিন সপ্তাহের অধিক সময় গণধর্ষণসহ তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। ফুলন দেবীর ওপর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল তারা সকলেই ছিল উচ্চবর্ণের ঠাকুর গোত্রীয় ক্ষত্রিয় শ্রেণীর। ২৩ দিন পর ফুলন নিজেকে ঠাকুর সম্প্রদায়ের গ্রাম বেহমাই-এ নিজেকে আবিষ্কার করেন। অবশেষে এক ব্রাহ্মণ ব্যক্তির সাহায্যে ফুলন গরুর গাড়ি করে বেহমাই থেকে পালিয়ে যায়।

বেহমাই থেকে পালিয়ে আরেক দস্যু মান সিংয়ের সঙ্গে ডাকাত দল তৈরি করেন ফুলন দেবী। এরপর ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দল নিয়ে বেহমাই গ্রামে ফিরে যান ফুলন দেবী। সেখানে গিয়ে তারা গ্রামবাসীকে বলেছিলেন শ্রীরামকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পুরো গ্রামে শ্রীরামকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ২২ জন ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফুলন দেবীর দলের সদস্যরা।

সেই ঘটনায় গোটা ভারতে ব্যাপক আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং। হত্যাকাণ্ডের পর ফুলন দেবীর নাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তাকে ভারতে অত্যাচারিত, দলিত, নিম্নবর্ণের ও আদিবাসীদের প্রতিবাদী মুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি, তাকে নিয়ে তৈরি হয় চলচ্চিত্রও, যেটি পরিচালনা করেছিলেন শেখর কাপুর। তার জীবনী নিয়ে লেখা বইটির নাম ছিল ‘ইন্ডিয়াস ব্যান্ডিট কুইন : দ্য ট্রু স্টোরি অব ফুলন দেবী’। তারপর থেকে ফুলন দেবী ‘ব্যান্ডিট কুইন’ নামেও পরিচিত হয়েছিল।

পরে একটি সাধারণ ক্ষমা প্রকল্পের অধীনে হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ফুলন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন। সে বছর সমাজবাদী পার্টির তৎকালীন প্রধান ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়েম সিং যাদবের আদেশে ফুলন দেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

১৯৯৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেন। কোনো ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও তিনি উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় লোকসভা নির্বাচনে জেতেন।

সংসদ সদস্য থাকা অবস্থাতেই ২০০১ সালের ২৫ জুলাই তার দিল্লির বাসভবনের সামনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে শের সিং রানা নামের এক যুবক।

ধর্ষণের বদলা নিতে ২০ জনকে খুন করেছিল ডাকাতরানি ফুলন দেবী এবং তার দলের সদস্যরা। সেই হত্যাকাণ্ডের ৪৩ বছর পর বৃহস্পতিবার সাজা ঘোষণা করল উত্তরপ্রদেশের কানপুরের একটি আদালত। ২০ জনকে হত্যার ঘটনায় ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তবে বিচার চলাকালীন অভিযুক্তদের মধ্যে ৩২ জনই মারা গিয়েছেন। বেঁচে থাকা দুজনের মধ্যে একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া, প্রমাণের অভাবে অন্যজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions