বান্দরবান:- ওপারে মিয়ানমারে লড়াই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। একের পর এক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী। লড়াইয়ের আঁচ লাগছে সীমান্তের এপার বাংলাদেশেও। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর গতকাল উখিয়ায় আহত হয়েছেন সাতজন। এর পর থেকে সীমান্ত এলাকার মানুষ সরে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন মিয়ানমার বাহিনীর সদস্যরা। এ অবস্থায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সতর্ক করে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে সরকার।
কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালীর বালুখালী জমিদারপাড়ায় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য প্রয়াত ইসলাম খানের বাড়ি। সীমান্ত লাগোয়া বাড়িটির পূর্ব দিকে আধা কিলোমিটার ধানখেত। এরপর নাফ নদী। ওপারে একটি সড়ক, তার পাশ ঘেঁষে মিয়ানমারের ডেকুবুনিয়া চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দখলে নিতে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়ছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় গোলাগুলি শুরু হতেই স্থানীয় লোকজনকে হুড়মুড়িয়ে প্রয়াত ইসলাম খানের বাড়ির টিনের বেড়ার পাশে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। এ সময় সংঘাতে থাকা মিয়ানমারের দুই পক্ষই বাংলাদেশেও ঢুকে পড়ে।
স্থানীয় সূত্র বলেছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের ভেতরে দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশনের (আরএসও) ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলছে। সেখান থেকে ছুটে আসা মর্টার শেলের আঘাতে বান্দরবানে গত সোমবার দুজন নিহত হয়েছেন। গত কয়েক দিনে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে গতকাল উখিয়া সীমান্ত এলাকায় সাত বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। এদিকে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যসংখ্যা বেড়ে ২৬৪ জন হয়েছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
গতকাল উখিয়ার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দামনখালী, রহমতেরবিল, চাকমা কাটাসহ অন্তত সাতটি এলাকায় গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। গোলাগুলির একপর্যায়ে কয়েকটি গুলি বালুখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে পড়ে। অবশ্য স্কুলটি বন্ধ ছিল।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম গহুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রহমতেরবিলে সাত বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কজনক। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমাকে রহমতের বিলের বাসিন্দারা ফোন করে জানান, বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছে। আমি দৌড়ে সেখানে যাই। এ সময় মিয়ানমার বাহিনীর ১১১ জন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। আমরা, বিজিবি গিয়ে তাদের ধরে ফেলি। একই সময় একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ২৪ জনকে আটক করি। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল। সেগুলো বিজিবি হেফাজতে নিয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার পর গোলাগুলির শব্দ আর পাওয়া যায়নি।’
এদিকে সকাল সোয়া ৯টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল এসে পড়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়ায়। মর্টার শেলটি ঘুমধুম উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়ির উঠানের আমগাছে লেগে মাটিতে গেঁথে যায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্ত এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছেন আরাকান আর্মির সদস্যরা। এই এলাকায় গতকাল কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। তবে সীমান্ত এলাকার মানুষ কেউ বাড়িঘরে থাকছে না।
গতকাল বিকেল ৪টায় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত এলাকায় সমস্যার কারণে সাময়িকভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য এলাকার লোকজনকে অনুরোধ করা হচ্ছে। দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা আছে, সেখানেও যেতে পারবে স্থানীয় বাসিন্দারা।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতকাল বিকেল পর্যন্ত স্থানীয় কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।
সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে
টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি।’
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গতকাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিবির মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘সোমবার রাত পর্যন্ত মিয়ানমারের বিজিপি, সেনাবাহিনী, অন্যান্যসহ ১১৫ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে ১১৪ জন যোগ হয়েছেন। দুপুরের মধ্যে আরও ৩৫ জন এসেছেন। বর্তমানে ২৬৪ জন আছেন। আমরা তাঁদের আশ্রয় ও খাবার দিয়েছি। তাঁদের মধ্যে আহত ১৫ জন। ৮ জনের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের ৪ জনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এবং বাকিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় আসার পথে খবর পেলাম, ৬৫ জন রোহিঙ্গা নৌকায় করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। টেকনাফে বিজিবি তাদের ঠেকিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে। আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেব না।’
রাষ্ট্রদূতকে তলব, মর্টার ছোড়ায় প্রতিবাদ
কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা জানান, সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয় মিয়ানমারের এমন কোনো উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার যাতে বাংলাদেশের আকাশসীমায় না ঢোকে, সে জন্য দেশটিকে সতর্ক করে দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি সরকার মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে ডেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির এ সতর্কতার কথা জানান। বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের জন্য রাষ্ট্রদূতের কাছে মহাপরিচালক একটি কূটনৈতিক চিঠিও হস্তান্তর করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে প্রাণহানি ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়, এমন কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
বিজিবির সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা জানান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সঙ্গে পুলিশও কাজ করছে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য রাজ্জাককে গতকাল রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে নিহত দুজনের পরিবার কাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, ‘কে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। আমরা একটা মামলা নিয়েছি। আসামি অজ্ঞাতনামা। তদন্তে যাদের নাম আসবে, পরবর্তী সময়ে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আজকের পত্রিকা