ডেস্ক রিরোট:- প্রচলিত কবিতার পঙক্তি ‘পিঠা যাবে কুটুম পাড়া, ভোরের আগে ভীষণ তাড়া’ বাঙালি জীবনের এক অপরিহার্য সংস্কৃতির সঙ্গে যথার্থভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আবহমান গ্রাম-বাংলায় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পিঠা-পুলি পাঠানোর রীতি দীর্ঘদিনের। এখনও শীত এলে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। তবে গতিময় জীবনে তা শহরে অনেক সময়ই হয়ে ওঠে না। সময়ের পরিবর্তনে ‘কুটুম পাড়ায়’ পাঠানোর সেই শীতকালীন নানান পিঠা এখন বিক্রি হচ্ছে অনলাইন প্লাটফর্মে।
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে কত শত রকমের পিঠা যে বানানো হয়, তার শেষ নেই। বেশিরভাগ পিঠাই বানানো হয় শীতকালে। এর মধ্যে চিতই, পাকোয়ান, পক্কন, পাটিসাপটা, কুশলি, ভাপা, কাটা, নকশি, পুলি, দুধ পিঠা, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা, গড়গড়া, ম্যারা, মুঠা, পুতুল পিঠা, চাঁছি, ঝুড়িসীতা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, জামদানি পিঠা, হাদি পিঠা, পাটা পিঠা, তেলেভাজা পিঠা প্রভৃতি বেশ জনপ্রিয়।
যদিও নাগরিক ব্যস্ততায় কিংবা পিঠা বানানোর সঠিক উপকরণ না জানায় বেশিরভাগ চাইলেও শীতের বাহারি রকম পিঠা খাওয়া হয়ে ওঠে না রাজধানীবাসীর। নগরবাসীকে পিঠার স্বাদ দিতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। ‘মম’স ফুড হাউস’, ‘অনলাইন পিঠা বাড়ি বিডি’, ‘পিঠা ঘর’, ‘নওয়াবি পিঠা’, ‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’, ‘গ্রামীণ পিঠা ঘর’, ‘গ্রাম বাংলার নকশি পিঠা’, ‘শর্মিলার পিঠা বাড়ি’ ইত্যাদি নামের বিভিন্ন ধরনের ফেসবুক পেজ থেকে বিক্রি হচ্ছে শীতকালীন পিঠা।
তবে অনলাইনে শীতকালীন সবধরনে পিঠা পাওয়া কঠিন। সহজে নষ্ট হয় না, বহনযোগ্য পিঠাগুলোই বেশি পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— চিতই, বিবিখানা, পাটিসাপটা, ভাপা, ঝিনুক বা খেঁজুর পিঠা, নকশি পিঠা, মালপোয়া বা তেলের পিঠা, ঝালপুলি, ভাপাপুলি, সাজ পিঠা, দুধ পায়েস, বিস্কুট পিঠা, মুঠা পিঠা, পুলি পিঠা ও ক্ষীরপুলি ইত্যাদি পিঠার অনলাইনে বেশ চাহিদা আছে।
নিজ হাতে পিঠা তৈরি করে তা অনলাইনে বিক্রি করেন ‘মম’স ফুড হাউসের’ উদ্যোক্তা ফাহিমা খান। পিঠা বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি করোনার সময়ে অনলাইনে জিনিসপত্র বিক্রির উদ্যোগ নেই। তখন বিভিন্ন ধরনের আচার ও সুস্বাদু খাবার বিক্রি করতে শুরু করি। পরে ধীরে ধীরে বিক্রির আইটেম বাড়াতে থাকি। এখানে মসলাও বিক্রি করি। শীতকালে চারদিকে শীতের পিঠার চাহিদা বেড়েছে দেখে আমিও পিঠা বিক্রি শুরু করি। এখন দুধচিতই, বিবিখানা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, ভাপা পিঠা সহ বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন পিঠা বিক্রি করছি।’
অনলাইনে বেচাকেনা কেমন হয় এবং পিঠা কতটুকু মানসম্মত হয় এমন প্রশ্নের জবাবে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘রেগুলার দিনের চেয়ে ছুটির দিন বেচাকেনা একটু বেশি হয়। মানুষ ছুটির দিন বাসায় বসে ফ্রি সময়ে অনলাইন ঘাঁটাঘাঁটি করে অর্ডার দেয় সম্ভবত এই কারণে। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা বেচাকেনা নিয়ে সন্তুষ্ট।’
অনলাইনে পিঠার মান নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজ হাতে ঘরে বসে পিঠা তৈরি করি। এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা অন্য কোন সমস্যা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া পিঠার দামও সবার নাগালের মধ্যে।’
শীতকালীন পিঠার পাশাপাশি অনলাইনে গুড়ের চাহিদাও প্রচুর। অনলাইনে পিঠা ও গুড় বিক্রেতা রিক্তা বেগম বলেন, ‘আমরা অনলাইনে গত তিন বছর ধরে পিঠা ও গুড় বিক্রি করছি। গুড় বিক্রি হলেও আগে তেমন পিঠা বিক্রি হতো না। তবে এখন পিঠা বিক্রি অনেক বেড়েছে। আগের তুলনায় এখন মানুষের অনলাইনে শীতের পিঠা কেনার আগ্রহ বেড়েছে, তবে এটা শুধু রাজধানীতেই। আর গুড়ের জন্য সারা দেশ থেকে অর্ডার আসে। আমরা যশোর থেকে পাইকারি কিনে তা অনলাইনে বিক্রি করি। গুড়ের বিষয়টা আমার স্বামী দেখে। আর পিঠা বানানো ও বিক্রির পুরো বিষয়টি আমি দেখি।‘
নিয়মিত অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে একজন নাদিয়া হায়দার। অনলাইন থেকে কেনাকাটার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার হাসব্যান্ড আর আমি দুজনেই চাকরিজীবী। ঝামেলা এড়াতে ও সময় বাঁচাতে অনলাইনে কেনাকাটা। ব্যস্ততার কারণে তেমন দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করা হয় না। তাছাড়া এখন অনলাইনেই সব কিছু পাওয়া যায়। তবে এখানে আবার মাঝেমধ্যে প্রতারিত হতে হয়। তবে পপুলার শপে এই ঝুঁকিটা কম থাকে।’
অনলাইনে থেকে পিঠা কেনার বিষয়ে নাদিয়া হায়দার বলেন, ‘অফিস থেকে বাসায় এসে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাসায় এসে রান্না করা বা রান্না করে অফিস করতে যাওয়া বেশ যন্ত্রনার। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় বাইরে খাওয়া হয়। এতো শত ঝামেলা নিয়ে খাবার তৈরির বাইরে বাচ্চাদের জন্য বা নিজেদের নিচ্ছে হলেও পিঠা বা অন্য সব মুখরোচক খাবার বানানো হয় না। এখন মন চাইলেই অনলাইন থেকে কেনা যায়। অনলাইনে পিঠা বিক্রির উদ্যোগ যারা নিয়েছে তাদের সাধুবাদ জানাই।’
অনলাইনে পিঠা ও গুড় কেনার বিষয়ে সাংবাদিক মাহফুজ আহমেদ বলেন, ‘ক্রেতাদের খাঁটি-ভেজাল সংশয়কে পুঁজি করে অনেকে অনলাইনে গুড় বিক্রি করছেন। এদিক দিয়ে সব বিক্রেতায় সফল। তবে কোনও কোনও ক্রেতা অনলাইন থেকে গুড় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। যার কারণে পরিচিত ছাড়া অনলাইনে তেমন কেনাকাটা হয় না। আমি নিজেও একবার যশোরের খাঁটি গুড় দেখে দুই কেজি গুড় কিনেছি। কিন্তু হাতে পাওয়ার পর দেখি গুড়টা ভালো না। চিনি মেশানো গুড়। এইজন্য এখান পরিচিত ছাড়া অনলাইনে অর্ডার দেই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইনে এখন অসংখ্য পরিচিত মানুষ পিঠা বিক্রি করে। দাম তেমন একটা বেশি না। তবে কথা হচ্ছে কিছু পিঠা গরম গরম চুলা থেকে নামিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। যেটা আসলে অনলাইন থেকে কিনলে পাওয়া যায় না। তবে পিঠার ক্ষেত্রে এখনও অনলাইনে প্রতারিত হইনি। এই শীতেই পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, ভাপা পিঠাসহ আরও কয়েক আইটেমের পিঠা পাঁচ-ছয় বার কেনা হয়েছে। দাম অনুযায়ী পিঠাগুলো বেশ ভালো ও মানসম্মত মনে হয়েছে।’
অনলাইনে গুড়অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে গুড়
অনলাইনে পিঠা বিক্রির বিষয়ে অভিযোগ তেমনটা পাওয়া না গেলেও গুড় বিক্রির প্রতারণা নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যায় হরহামেশাই। খাঁটি গুড়ের কথা বলে ভেজাল ও চিনি মেশানো গুড় বিক্রি করছেন অনেকেই। আবার খাঁটি গুড়ের জন্য পরিচিতিও পেয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে ‘ঘরের বাজার’, ‘সুন্নাহ’, ‘কৃষিজ’, ‘টাটকা পণ্য’, ‘ফুড স্ট্রিট’, ‘অর্গানিক ফুড’, ‘গুড় বাজার’ ইত্যাদি নামের অনলাইন পেইজ থেকে গুড় নিয়মিতই বিক্রি হচ্ছে।
অনলাইন থেকে গুড় কেনার বিষয়ে নিয়মিত অনলাইন প্লাটফর্মে কেনাকাটা করা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘একটু যাচাই-বাছাই করে বা রিভিউ দেখে অনলাইন থেকে পণ্য কিনলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বর্তমানে অনলাইন প্লাটফর্মে লাখ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এই বেচাকেনার মাধ্যমটিকে সরকারিভাবে মনিটরিং করলে বা একটা সিস্টেমের মধ্যে আনলে কেউ প্রতারণার সাহস পেতো না।’বাংলা ট্রিবিউন