নাগরিক সমাজ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ার লাভ-ক্ষতি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ১২০ দেখা হয়েছে

এহ্‌সান মাহমুদ:- এইভাবে নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় নিজ দলের সমর্থক নাগরিক সমাজের বক্তব্য, বিবৃতি প্রচার করার মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা সহজ হয়। কিন্তু এইভাবে দলীয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে যেকোনো রাজনৈকি দল হয়তো লাভবান হতে পারে, কিন্তু নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ তাদের কিছু বৈষয়িক লাভ ছাড়া আর কোনো অর্জন কি আছে? এইভাবে নাগরিক সমাজ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ার লাভ-ক্ষতি এখনই হিসাব করতে না বসলে দেশটা একদিন নাগরিক সমাজহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও আমলে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ইতিহাস এখনো চার দশকও হয়নি; এমন একটি রাষ্ট্রে দুর্বল সুশাসন, জবাবদিহির নিশ্চয়তা না থাকা সমাজে একটি বিবেকবান, শিক্ষিত, ন্যায়পরায়ণ, সংস্কৃতিমনস্ক, দলনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের উপস্থিতি সবচেয়ে জরুরি

অতীতে সরকার, রাজনৈতিক দলের বাইরেও এক ধরনের বিদ্যোৎসমাজ দেখা যেতো। যাদের আমরা চিহ্নিত করতাম কিছু লক্ষণ দেখে। যারা অনেকটা সামাজিক ভালো-মন্দের, অনুশাসনের দেখভাল করতেন। নিজেদের মতামত জানাতেন। সীমিত পরিসরে হলেও সরকারকে সহায়তা করতেন। তবে যার জন্য তারা সরকারের চক্ষুশূল হতেন সেটি হলো- বেশির ভাগ সময় জনসাধারণের ওপর সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাড়াবাড়ির নজরদারি করতেন। এসবের মধ্যদিয়ে তারা জনসাধারণের সামনে সমীহের পাত্র হিসেবে পরিগণিত হতেন।

এই নাগরিক সমাজের অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তারা প্রদর্শন করতেন না।

সাতচল্লিশের দেশ ভাগ থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুুক্তিসংগ্রাম, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরবর্তী সময়, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এমনকি ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার বাইরে যে ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল তার নেপথ্যেও নাগরিক সমাজের একটি ভূমিকা ছিল। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের টানা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার প্রেক্ষিতে এই নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এটা ক্ষমতাসীনরা যে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে করেছেন, তা শতভাগ সত্য নয়। এক্ষেত্রে এই নাগরিক সমাজের পরিণতির সঙ্গে কেবল সতীদাহ প্রথার তুলনা চলে। ভিন্ন অর্থে হলেও এখানকার নাগরিক সমাজের একটি বৃহৎ অংশ কার্যত স্বেচ্ছা মৃত্যু বেছে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজের যে ঐতিহ্য তা যেমন হরণ করা হয়েছে, একইসঙ্গে গোটা দেশের নাগরিক সমাজকে একটি অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখে নিয়ে আসা হয়েছে।

বাংলাদেশে এক সময়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ছিলেন রবার্ট ওয়াটকিন্স। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে তিনি একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধে তিনি নাগরিক সমাজের প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছিলেন এইভাবে- ‘নাগরিক সমাজের প্রবণতাই হচ্ছে মাঝে মাঝে বিদ্যমান অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা, যা আরও উদার ও অংশীদারিত্বমূলক সমাজের দিকে ধাবিত হতে পারে। যার জন্য সমাজে শুধু ভিন্নমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহনশীলতাই নয়; অর্থবহ, ইতিবাচক সংলাপ ও বিতর্কের জন্য উদারতারও প্রয়োজন। চিন্তার উদারতার অভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা থাকে, যার প্রকাশ ঘটতে পারে সহিংসভাবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। নাগরিক সমাজের জন্য সহায়ক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আদর্শিক কোনো মানদণ্ড নেই। যদিও এ ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে, নাগরিক সমাজ সেখানেই গড়ে উঠবে, যখন রাষ্ট্র কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক আইন চাপিয়ে দেবে না বরং এর পরিবর্তে নাগরিকদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে। শক্তিশালী নাগরিক সমাজ যুগপৎভাবে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত এবং এর পরিণতি।’

স্থিতিশীল গণতন্ত্রের যে শর্ত রবার্ট ওয়াটকিন্স উল্লেখ করেছেন, তা আমাদের দেশের এতকাল নাগরিক সমাজ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসা শ্রদ্ধেয় ও বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিগণ আমলে রাখবেন? আমাদের সহজাত প্রবণতা হচ্ছে বিদেশির কথা শোনা। এইবার একই বিষয়ে একজন দেশীর বক্তব্য এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেছিলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে দেশে নাগরিক সমাজের অনেকে কী ভূমিকা নেবেন সে বিষয়ে সংকটে পড়েছেন। তাদের একটি অংশ ক্ষমতাসীনদের তোষামোদি করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য চরম লজ্জাহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন।’
একটা সময়ে আমাদের পূর্ব- পুরুষরা কলের গান শুনতেন। আমরা ফিতার অডিও ক্যাসেটের যুগ থেকে সিডি, ভিসিডি পেরিয়ে এখন ইউটিউবে এসে নোঙর করেছি। সেখানে অনেকেই গাইছেন। আমরাও শুনছি। অতীতে আমরা যে নাগরিক সমাজ দেখেছিলাম, সেইসব সোনালী দিন না হয় আমরা ফিরে পাবো না; তাই বলে হারানো দিনের গান অন্তত ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে শোনার মতো করে হলেও নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর আমরা কেন শুনতে পাবো না? নাকি ক্যাসেট প্লেয়ার বাজানোর লোকের সংখ্যাও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে?

গত বছরের ৭ই অক্টোবরে ঢাকায় ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’- অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়, ‘রাজনৈতিক বৈধতা আছে, এমন কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের কারণে এই অঞ্চলে সর্বজনীন মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নাগরিক সমাজের কাজে যুক্ত সংস্থাগুলোর কাজের ক্ষেত্র হুমকির মুখে পড়েছে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বিকাশে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে যখন জনগণ পিছু হটে, সে সময় নাগরিক সমাজকে দমিয়ে রাখা হয়। এটি কোভিড-পরবর্তী ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সময় আরও বেশি হয়েছে। এখন নাগরিক সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় এসেছে। তাদের তৃণমূলে গিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছানো, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং সংহতি গড়ে তোলার সময় এসেছে।’
নাগরিক সমাজকে যখন পুনরুজ্জীবিত করার কথা সেই সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি নাগরিক সমাজের একটি অংশ সরকারের এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের ৫ দশকে যে শ্রেণিটি এখানে নাগরিক সমাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তাদের প্রথম দিকে একটি বড় অংশ এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শরীরের সঙ্গে লড়াই করে ঘরের বাইরে তাকানোর সঙ্গতি হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। এরপরে যে আরেকটি নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে, সেটি মূলত শহুরে, কর্পোরেট দরজা পেরিয়ে মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা পর্যন্ত প্রবেশের আমন্ত্রণ পায়নি। এখন মূলত এই শ্রেণিটি দেশের প্রচারযন্ত্র কিংবা মিডিয়ায় উপস্থিতির মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজ হিসেবে বহুলভাবে প্রচার পেয়ে আসছেন। পরিতাপের বিষয় হলো- এই শ্রেণিটির বেশির ভাগই আবার ক্ষমতাসীনদের অনুগামী। আর তাই দেশের সংকটে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ধরা যাক, রাজনৈতিক সংলাপের অভাব হলে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এখন সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সঠিক নাগরিক সমাজের অভাবে দেশের প্রয়োজনে তারা উদ্যোগী হতে পারছেন না। অতীতে অবশ্য কিছু তেতো অভিজ্ঞতাও হয়েছে নাগরিক সমাজের। জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে অনেককে। কিন্তু স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং ঐতিহাসিক ও স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এগিয়ে যাবে এমন নাগরিক সমাজের অভাব দিনদিন প্রকট হচ্ছে।

বিপরীতে, সরকার বেশ দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে নাগরিক সমাজ তৈরি করে ফেলেছে। তারা বৃক্ষ কাটা বিষয়ে যতটা সোচ্চার কিংবা প্রজাপতি মেলা আয়োজনের জন্য যতোটা তৎপর সরকারি অসঙ্গতি নিয়ে অনেকটাই নীরব। আবার দুষ্ট পুঁজির মালিকদের গণমাধ্যমের লাইসেন্স প্রদানও তথ্যপ্রবাহকে একমুখী করে ফেলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কারণ মিডিয়া ট্রায়াল দ্বারা অনেক কিছু প্রভাবিত করা যায়। এইভাবে নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় নিজ দলের সমর্থক নাগরিক সমাজের বক্তব্য, বিবৃতি প্রচার করার মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা সহজ হয়। কিন্তু এইভাবে দলীয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে যেকোনো রাজনৈকি দল হয়তো লাভবান হতে পারে, কিন্তু নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ তাদের কিছু বৈষয়িক লাভ ছাড়া আর কোনো অর্জন কি আছে? এইভাবে নাগরিক সমাজ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ার লাভ-ক্ষতি এখনই হিসাব করতে না বসলে দেশটা একদিন নাগরিক সমাজহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও আমলে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ইতিহাস এখনো চার দশকও হয়নি; এমন একটি রাষ্ট্রে দুর্বল সুশাসন, জবাবদিহির নিশ্চয়তা না থাকা সমাজে একটি বিবেকবান, শিক্ষিত, ন্যায়পরায়ণ, সংস্কৃতিমনস্ক, দলনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের উপস্থিতি সবচেয়ে জরুরি। লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions