চট্টগ্রাম:- চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও অন্তর্বতীকালে কক্সবাজারের সঙ্গে ট্রেন চলাচলের জন্য পুরোনো জরাজীর্ণ সেতুটিকেই সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। এতে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুর ওপর এই অর্থ ব্যয় পুরোটা অপচয় হবে বলে পুরকৌশলের এক অধ্যাপক যেমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তেমনি এটিকে লুটপাটের আয়োজন বলে মনে করছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমামের মতে, সংস্কার করে সেতুটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হলে এটি সর্বোচ্চ এক বছর চলবে এবং তা-ও হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
আজকের পত্রিকাকে অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে কালুরঘাট সেতুর সংস্কার নিয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাইমূলক গবেষণা করা হয়েছে। ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সংস্কার করেও এই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে না।
অধ্যাপক ইমাম বলেন, ‘সংস্কারের নামে অন্তত ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এটা অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। আমি শতভাগ নিশ্চিত, সংস্কার করেও এই সেতু সর্বোচ্চ এক বছর সার্ভিস দেবে। তাহলে কাজের কাজ কি কিছু হবে?’
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সংস্কারের ব্যয়টি নির্ভর করছে বুয়েটের ডিজাইনের ওপর। এই খরচ বাড়তেও পারে, কমতেও পারে।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, ২০১৯ সালে নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণের জন্য আলাদা প্রস্তাবনা আসে। এখন নতুন কালুরঘাট সেতু হবে। যেহেতু এখনই নতুন সেতু সম্ভব নয়, সে জন্য পুরাতন সেতুকে ট্রেন চালানো উপযোগী করাই লক্ষ্য। এই সেতু সংস্কার করে তার ওপর রেললাইন নির্মাণের কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়।
কালুরঘাট সেতুর ফোকাল পারসন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, বুয়েটের কাছে ২৫ এক্সেল লোডের ট্রেন চালানোর উপযোগী নকশা চাওয়া হয়েছে। তা পেতে আরও ৪ মাস লাগতে পারে। তখন নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ এবং তারপর পুরাতন সেতু সংস্কার করতে আরও এক বছর লাগতে পারে।
চুয়েটের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। সে সময় পুরাতন কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন যেতে পারবে কি না, সেটি মাথায় রাখেনি সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ২০১৭ সালে ঠিকাদার নিয়োগ হওয়ার পরও কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি তুলে ধরা হয়নি।
‘ওই প্রকল্প নেওয়ার শুরুতেই কালুরঘাট সেতু দিয়ে যে নতুন ট্রেন চালানো সম্ভব নয়, তা তুলে ধরে নতুন সেতু নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলাম।’
অধ্যাপক ইমাম বলেন, ২০২৮ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৯ সালের প্রথম দিকে নতুন সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজারে ট্রেন চালাতে চায় রেলওয়ে। সে ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে এই সেতু।
‘কারণ, এই সেতু দিয়ে বর্তমানে যেসব ট্রেন যায়, সেগুলো ১১ দশমিক ৯৬ টন এক্সেল লোডবিশিষ্ট অর্থাৎ ছোট লোকোমোটিভ বা হালকা ওজনের কোচ। কিন্তু কক্সবাজারে যেসব ট্রেন নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে, রেলওয়ের সেসব ট্রেনের ইঞ্জিন ১৫ এক্সেল লোডের।’
সে জন্য ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এই সেতুর ওপর দিয়ে ১৫ এক্সেল লোডের ট্রেন চালানো যায় কি না, তা যাচাই করতে বুয়েটের দ্বারস্থ হয় রেলওয়ে। ২০২১ সালে অক্টোবরে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের পর্যবেক্ষক দল সেতু পরিদর্শন করে জানালিহাট অংশে আবৃত প্রাচীর এবং সুরক্ষাদেয়ালে ফাটল খুঁজে পায়। এ ছাড়া আরও বড় ধরনের ছয়টি ত্রুটি চিহ্নিত করে তারা।
বুয়েটের পর্যবেক্ষক দলের চিহ্নিত করা বড় ধরনের ত্রুটিগুলোর একটি হলো সেতুর ১ ও ১৫ নম্বর পিয়ার (একধরনের কাঠামো, যা মাটির নিচে বা পানির মধ্যে প্রসারিত থাকে) ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। এতে জাহাজ চলাচলের সময় সংঘর্ষ হলে পিয়ারগুলো ভেঙে যেতে পারে। এ ছাড়া সেতুর গার্ডার, ডেক, অ্যাঙ্গেল, গ্যাসেট প্লেট, রিভেট ও অন্যান্য অংশ অনেক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তাই সেতুটির ভার বহনের ক্ষমতা দিন দিন কমছে বলে জানিয়েছে পর্যবেক্ষক দল।
সেতুর ওপরের অংশের অ্যাপ্রোচ (সেতুর সঙ্গে সংযোগ সড়কটি) লাইনচ্যুত হওয়ার লক্ষণ দেখতে পান পর্যবেক্ষকেরা। তখন বুয়েটের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেতুতে গার্ডারের ভার বহনকারী ইস্পাতগুলো অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতুর দুই পাশের কাঠের পাটাতন ও লোহার বেষ্টনী ঠিকঠাকমতো আছে কি না, তা পরীক্ষা করা দরকার। কারণ, এসব যন্ত্রাংশের কাঠামো বেহাল অবস্থায় আছে। তবে সেতুর ফাউন্ডেশনে কোনো ত্রুটি পায়নি পর্যবেক্ষক দল।
লুটপাট করতেই নাজুক এই সেতু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে হাতে নেওয়া প্রকল্পটিতে কেন কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি? তখন বিষয়টি প্রকল্পে আনলে বাড়তি এই ব্যয় হতো না। পাশাপাশি নতুন সেতুও হতো, ঠিক সময়ে কক্সবাজার লাইনে ট্রেনও চলত। এটি মূলত তাঁরা ইচ্ছে করেই করেন, নতুন কিছু মানেই লুটপাট। আজকের পত্রিকা