ডা. নূরজাহান বেগম:- প্রশ্ন: দুই সপ্তাহ আগে আমার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যেহেতু আমার প্রথম মা হওয়ার অভিজ্ঞতা, ফলে সব মিলিয়ে বুঝতে একটু সময় লাগছে। এখন ঠান্ডা পড়েছে, নবজাতকের পরিচর্যার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ? ঠিক কতক্ষণ পরপর তাকে কতটুকু খাওয়াতে হবে?
নতুন মা হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। ঠান্ডা কাশির ভয়ে নবজাতককে অনেক সময় অতিরিক্ত সাবধানে রাখতে গিয়ে কিছুটা ঝামেলায় পড়ে যান মা-বাবা। ঝামেলা এড়াতে কিছু বিষয় জেনে রাখা জরুরি।
যা জানতে হবে
নবজাতককে ঘড়ি ধরে খাওয়াতে হবে, ব্যাপারটা সে রকম নয়। আমরা বলে থাকি অন ডিমান্ড ব্রেস্ট ফিডিং; অর্থাৎ শিশু যখন খেতে চাইবে, তখন খেতে দিতে হবে। কখনো ১০ মিনিট পরেই তারা খেতে চায়, কখনো ২ ঘণ্টা পরও খেতে পারে। একটানা ২ ঘণ্টার বেশি ঘুমালে তখন উঠিয়ে খাওয়াতে হবে।
খাওয়ার সময় নবজাতক কিছু কিছু লক্ষণ দেখায়, যেমন আঙুল মুখে দেয়, পাশ ফিরে হাঁ করে দুধ খুঁজতে থাকে ইত্যাদি।
শিশুকে এক পাশের দুধ পুরো খেতে দিতে হবে। কারণ, প্রথমে পানির মতো পাতলা এলেও পরে ঘন দুধ আসে। এই ঘন দুধ বা হিন্ড মিল্কে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য সব পুষ্টি থাকে।
নবজাতক যখন এক পাশ খেয়ে ছেড়ে দেবে, তখন আরেক পাশের দুধ দেবেন। অনেক সময় এক পাশের দুধ খেয়েই পেট ভরে যায়। সে ক্ষেত্রে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। পরেরবার যে পাশ থেকে খায়নি, সেটা আগে দেবেন।
শুধু দুধের বোঁটা খাওয়াবেন না। বোঁটাসহ কালো অংশের অনেকটা শিশুর মুখে থাকবে, তা না হলে ঠিকমতো দুধ পাবে না এবং দুধের বোঁটা ফেটে যাবে।
খাওয়ানোর শেষে সঙ্গে সঙ্গেই শোয়াবেন না। উঁচু করে কমপক্ষে ২০ মিনিট রাখতে হবে। ঢেকুর যে সব সময় তুলবে, ব্যাপারটা তা নয়। উঁচু করে রাখলেই হবে। অনেকে ঘাড়ের ওপর নিয়ে শিশুর পেট চেপে রাখেন। সে ক্ষেত্রে বমি করে দিতে পারে।
বেশির ভাগ নবজাতক সারা দিন ঘুমাতে থাকে, রাতে জেগে থাকে। ঘুমের সময় ঠিক হতে কখনো কখনো তিন মাস লেগে যায়। তাই নতুন মায়েরা যখনই সময় পাবেন, নিজেদের মতো করে বিশ্রাম নিয়ে নেবেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সবার সহযোগিতা ছাড়া মায়ের একার পক্ষে খুব কষ্ট হয়ে যায়।
মায়ের খাবারের ওপর নবজাতকের বুকের দুধ পাওয়া এবং দুধের গুণগত মান নির্ভর করে। তাই মায়ের খাবারের বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
মায়ের খাবারের সঙ্গে শিশুর পেটব্যথা বা ঘন ঘন পায়খানা করা কিংবা রাতে কান্নাকাটি করার কোনো সম্পর্ক নেই।
মায়ের খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন রাখতে হবে। সঙ্গে শাকসবজি, ফলমূল, দুধ বা দুধের তৈরি খাবার দিতে হবে এবং তরল খাবার বেশি খাওয়ার ব্যাপারে নজর রাখতে হবে। বুকের দুধ খাওয়ানোর পরপরই তরল কিছু খেয়ে নিতে হবে।
নবজাতক প্রতিবার খাওয়ার পর অল্প অল্প তরল ছানা ছানা পায়খানা করে। এটা স্বাভাবিক। কখনো কখনো দিনে ১৫ থেকে ২০ বার পর্যন্ত পায়খানা করতে পারে। শুধু বুকের দুধ খাওয়া নবজাতক ৩ থেকে ৭ দিন পরপর পায়খানা করে। দুটোই স্বাভাবিক।
২৪ ঘণ্টায় ন্যূনতম ৬ বার প্রস্রাব করছে কি না, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সারা দিনে ৬ বার প্রস্রাব করার অর্থ হচ্ছে শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে।
নবজাতকের কান্নাকাটি মানেই দুধ পাচ্ছে না, এটা ভাবা ঠিক নয়। সে কান্নাকাটি করলেই মাকে দোষ দেওয়া কিংবা কৌটার দুধ খাওয়ানোর জন্য চাপ দেওয়া যাবে না।
সাধারণত ৩ বা ৪ সপ্তাহ পর থেকে অনেক শিশু সন্ধ্যার পর এবং রাতে অনেক বেশি কান্না করতে থাকে। লাল হয়ে যায় কান্না করতে করতে। এই সমস্যা বেশ কিছুদিন থাকে। সোজা করে কোলে নিয়ে রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে কিছু ওষুধ খাওয়ালে কিছুটা কমে। তবে অনেক সময় পুরোপুরি ভালো হয় না। এটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়।
নবজাতকের নাভিতে সেঁক দেবেন না; বিশেষ করে অনেকে সরিষার তেল দিয়ে সেঁক দিতে পছন্দ করেন। এতে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
অনেকের ধারণা, নাভি না পড়া পর্যন্ত শিশুকে গোসল দেওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে অনেক দিন গোসল না দেওয়ার জন্য পরে ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে।
জন্মের ৩ দিন পর থেকে প্রতিদিন নবজাতককে গোসল করাতে হবে। যেহেতু এখন শীতকাল, তাই যেদিন খুব বেশি ঠান্ডা পড়বে কিংবা শৈত্যপ্রবাহ থাকবে, সেদিন মাথাসহ পুরো শরীর মুছিয়ে দিতে হবে গোসল না করাতে চাইলে।
গোসলের পর সরিষার তেল ব্যবহার করবেন না। এতে শিশু ঘেমে গিয়ে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
তেল মাখাতে চাইলে গোসলের আগে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। গোসলের পর লোশন দিতে পারবেন।
সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারবেন।
শিশুর বয়স এক মাস না হলে চুল ফেলবেন না। চুল ঠান্ডা থেকে বাঁচায়। তবে বেশি বড় হয়ে গেলে ছোট করে দিতে পারেন। নবজাতকের চুল অপবিত্র নয়।
সোয়েটার, কাঁথা বা কম্বল দিয়ে শিশুকে সব সময় ঢেকে রাখবেন না; বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়। নবজাতকেরা খুব দ্রুত ঘেমে যায়। আপনি নিজেই বুঝে যাবেন, কখন ঢেকে রাখতে হবে, কতটা কাপড় পরাতে হবে।
এ সময় নবজাতকের নাক সব সময় বন্ধ থাকে। তাই খেতে গেলে বা নিশ্বাসের সময় শব্দ হয়, কোলে নিলে, পিঠে হাত দিলে ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়। এটার মানে ঠান্ডা লেগে থাকা নয়।
নাক পরিষ্কার রাখতে হবে এবং বারবার সাধারণ স্যালাইন নাকের ড্রপ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে বুকের দুধ খাওয়ানোর আগে।
প্রশ্ন: আমি সন্তান প্রসব করেছি ১১ দিন আগে। হাসপাতাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, শিশুর ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহার না করতে। কিন্তু আমার মা ও শাশুড়ি বলছেন, সরিষার তেল না দিলে হার শক্ত হবে না। এখন আমার কী করণীয়? আসলেই কি সরিষার তেল ক্ষতিকর?
পাপিয়া আক্তার, দিনাজপুর
নবজাতককে সরিষার তেল মালিশ করার সংস্কৃতি কিংবা সংস্কার আমাদের সমাজের যেমন চিরাচরিত অভ্যাস, ঠিক তেমনি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর প্রচলন রয়েছে; বিশেষ করে নেপাল ও জাপানে। নানা তর্ক, এমনকি গবেষণাও হয়েছে নবজাতকদের শরীরে সরিষার তেল মালিশ নিয়ে। এক দল গবেষক বলেন, কিছু উপকার রয়েছে তেল মালিশে। আবার গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সরিষার তেল নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর।
এই তেল ঝাঁজালো এবং ত্বকের ওপর আস্তরণ তৈরি করে। ফলে ময়লা জমে থাকে, দুর্গন্ধ হয়।
দেড় মাস পর্যন্ত শিশুর ত্বক বেশ পাতলা ও সংবেদনশীল থাকে। তাই সরিষার তেল প্রদাহ কিংবা র্যাশের কারণ হতে পারে। সুতরাং সরিষার তেল ব্যবহার না করাই ভালো। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নবজাতকের চোখে, নাকের ছিদ্র এবং নাভিতে কখনোই সরিষার তেল লাগানো যাবে না। বহু বছরের পুরোনো সংস্কার থেকে বের হয়ে আসা মুশকিল। তাই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের এসব বিষয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।
পরামর্শ দিয়েছেন: ডা. নূরজাহান বেগম, স্পেশালিস্ট, পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা