ডেস্ক রির্পোট:- গৌরবোজ্জ্বল অতীত। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালি জাতিকে মুক্তির জন্য প্রস্তুত করতে এ ভূমের বুদ্ধিজীবীদের অবদান অপরিসীম। সেখানেই থেমে থাকেননি তারা। মুক্তিযুদ্ধে স্বীকার করেছেন অপরিসীম ত্যাগ। অনেকে দিয়েছেন জীবনও। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামেও বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। জাতির দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তারা দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। রেখেছেন অভিভাবকের ভূমিকা। সেই দিন এখন আর নেই।
বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ সামগ্রিক পরিবেশে কিংবা ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার একটি অংশ বিভক্ত দলীয় ব্যানারে। রয়েছে পাওয়া-না পাওয়ার নানা হিসাবনিকাশ। এরমধ্যে সক্রিয় রয়েছেন কেউ কেউ। যদিও ১৮ কোটি মানুষের দেশে গণবুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আসলে কতো তা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে।
বুদ্ধিজীবী কারা? নানা মুনির নানা মত। ফ্রান্সে ৬০ এর দশকের ছাত্র আন্দোলনে বিখ্যাত দার্শনিক জাঁ পল সাত্র? সক্রিয় ভূমিকার জন্য এক ধরনের সার্বজনীন বুদ্ধিজীবীর আদর্শ চরিত্র হয়ে ওঠেন। বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি ‘দ্য রেসপনসিবিলিটি অব ইন্টেলেকচুয়াল’ লেখায় উল্লেখ করেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা এমন অবস্থানে থাকবেন যাতে সরকারের মিথ্যাগুলোকে উদাম করে দিতে পারেন এবং সরকারের গোপন অভিপ্রায়গুলো উদাম করে দেয়াই তাদের কাজ।’ ১৮৩৭ সালে এক বক্তৃতায় রালফ ওয়ান্ডো এমারসন প্রথম ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাতে তিনি বুদ্ধিজীবীর পাবলিক ফাংশন বুঝাতে গিয়ে ‘ওয়ান ম্যান’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ওয়ান ম্যান সেই একক ব্যক্তি যিনি চিন্তাশীলতার জগতে বিচরণ করেন। আর এই চিন্তার শক্তিই তাকে প্রশ্ন করতে তাড়িত করে। তিনি প্রয়োজনে বিরোধিতা করেন বা অমান্যও করেন।
বুদ্ধিজীবীর খোঁজে: বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে লেখক ও সাংবাদিক, নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর অভাব নাই। কিন্তু প্রশ্নটা হলো- জনস্বার্থের দিক থেকে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিজীবীর সংকট আছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে জনস্বার্থ পরায়ণ বুদ্ধিজীবিতার ঘাটতি আমাদের দেশে আছে। রাষ্ট্রের সহিংস চরিত্রের কারণে এইসব ধারায় স্বাধীন বুদ্ধিজীবিতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীদের একটা বিরাট অংশ নিজের জীবন-জীবিকা বা সম্মানহানির ভয়ে নিজেদের কোনো ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না। কিন্তু নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা ছাড়া মুক্ত চিন্তা প্রকাশ করা কঠিন। ফলে আমাদের দেশে অনেক মানুষ গণতন্ত্রপরায়ণ হওয়ার পরেও মুক্ত চিন্তা বা নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে ভয় পান।
অন্যদিকে প্রচলিত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ দলীয়ভাবে বিভক্ত হওয়ার ফলে আপন আপন দল ক্ষমতায় আসলে সেই দলের অন্যায়গুলোর পক্ষে ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অবস্থান নিয়ে থাকেন। ফলে দলীয় ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কোনো আগ্রহ তারা দেখান না।’ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি তরুণ সমাজের একটা অংশ ঝুঁকি নিয়ে হলেও এই জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক বিকাশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। তবে তাদের জন্য কাজটা শুধু রাজনৈতিক কারণেই কঠিন তা নয়, মিডিয়া, প্রিন্ট বই-পুস্তকের প্রচুর মূল্য বৃদ্ধি, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এবং মূলধারার মিডিয়াতে তাদের কম গুরুত্ব দেয়ার কারণে এই তরুণদের বিকাশ নানান দিক থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান বা নিরসন করতে পারলে আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবিতার যে সংকট তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তরুণরাই এই ক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারেন।’
গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘আপনি যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য তা খেয়াল করেন তাহলে বুদ্ধিজীবীর ব্যাপারটাও সহজে বুঝতে পারবেন। সমাজ তার নিজস্ব প্রয়োজনে এক ধরনের বুদ্ধিজীবী তৈরি করে এবং তারা তাদের মতো করে ফাংশন করে। সবসময় বুদ্ধিজীবী মানে যে, সুশীল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন হবে, মিডিয়াতে হাজির হবে, ফেসবুকে পোস্ট করবে- এমন না। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ দল নিয়ে মাথাও ঘামায় না। পার্টি আইডেনটিটি ফরমাল রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী বেলায় হয়তো কাজে লাগে। বাংলাদেশ সেভাবে ফরমাল রাষ্ট্রও না। এটা একটা ইনফরমাল রাষ্ট্র। ফলে এখানকার বুদ্ধিজীবীরাও ইনফরমাল। আমরা ভুল জায়গায় বুদ্ধিজীবী খুঁজছি। আমাদের মতো সমাজে বুদ্ধিজীবীরা বিরাজ করেন আরবান মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিরাচরিত বুদ্ধিজীবী সুলভ অবস্থানের বাইরে। সমাজ যেমন ইনফরমাল আমাদের সমাজের প্রয়োজনে এখানে অনেক ধরনের ইনফরমাল বুদ্ধিজীবী আপনি দেখবেন। আমরা হয়তো আমাদের ফরমাল পরিসরে তাদের স্বীকার করি না। শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিসরে বুদ্ধিজীবী না খুঁজে সাধারণ মানুষের সমাজে তাদের খুঁজতে হবে।’
তরুণ তাত্ত্বিক ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন মেডিসনের পিএইচডি গবেষক, সমাজ বিজ্ঞানী জুনায়েদ আহমেদ এহসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী একটা সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিখ্যাত লেখক পঙ্কজ মিশ্র ৯/১১ এর ঘটনার পরে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রসনের পক্ষে যখন বুদ্ধিজীবীরা মতামত দিচ্ছিল, তখন মন্তব্য করেছিলেন- এই ঘটনার মাধ্যমে লিবারাল সমাজে বুদ্ধিজীবিতার ভূমিকার ইতি ঘটে গেল। এটাকে তিনি সম্মিলিত আত্মহত্যা বলেছিলেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশে শাহবাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আজকে যে বুদ্ধিজীবীর সংকট দেখতে পাচ্ছেন তার কারণ- আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী হিসেবে এতদিন তারাই পরিচিত ছিলেন যারা শাহবাগের সময় (দুই/একজন ব্যতিক্রম বাদে) ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমাদের দেশে সাংস্কৃতিকভাবে ফ্যাসিবাদের ভিত শক্তিশালী করতে ইসলামবিদ্বেষী তথাকথিত সেক্যুলার মহল অনেক আগে থেকেই সক্রিয় ছিল। এখন এই ধারা ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিবাদ কায়েম করাতে তাদের ভূমিকারও ইতি ঘটেছে। তারা মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা বলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাই সমাজে আপনারা বুদ্ধিজীবী খুঁজে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে নতুন চিন্তা নিয়ে সততার সঙ্গে, দলীয় স্বার্থবুদ্ধির বাইরে ফাংশন করা নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীও তৈরি হতে পারছে না, কারণ- সমাজে চিন্তাশীল মতামতের চেয়ে হুজুগের প্রতি ঝোঁক বেড়ে গেছে। ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। অধ্যবসায় বা সাধনার দিকে আগ্রহ কম।
বুদ্ধিজীবীর হদিস ও চরিত্র লক্ষণ জানতে লেখক ও সাহিত্য পত্রিকা প্রতিধ্বনি’র সম্পাদক সাখাওয়াত টিপুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেই কবেই তো গ্রামসি দুই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর কথা বলে গেছেন। অর্গানিক ও ট্রেডিশনাল। অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরাই আসলে বুদ্ধিজীবী বা সমাজের জন্য জরুরি বুদ্ধিজীবী। বাকিরা হয়তো দলের জন্য বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য কাজ করেন। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে আমরা বুদ্ধিজীবী বলতে বুঝবো, যিনি সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও সাহস করে সত্য উচ্চারণ করেন। এখানে মনে রাখতে হবে ‘সাহস’ ও ‘সত্য’-এই দুইটাই মূল বিষয়। তিনি কোন মাধ্যমে কাজ করেন সেটা বিষয় না। তিনি ছবি আঁকেন নাকি গান করেন নাকি দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেন নাকি বীজ নিয়ে কাজ করেন সেটা বিষয় না। বিষয় হলো, সাহস করে সত্য বলেন কিনা! আর একটা বিষয় আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিতা মূলত বাম ঘরানার চিন্তা ও সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখানে শ্রেণি প্রশ্ন প্রধান না হয়ে জাতীয়তাবাদী প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতি তথা রাষ্ট্র গঠন নিয়ে বামদের তেমন চিন্তা ছিল না। তারাও জাতীয়তাবাদের তোড়ের মুখে ‘চুপসে’ গেছে। ফলে রাষ্ট্র গঠন ও জাতীয় সংকটের কালে আমরা তেমন বুদ্ধিজীবী পাই না।’
ফিটনেস কনসালটেন্ট মারজিয়া আক্তার মনে করেন, ‘আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবাই যে সরকারদলীয় অবস্থান থেকে কথা বলেন তা না কিন্তু মোটা দাগে বুদ্ধিজীবীরা সবসময় সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যক্তির একান্ত মৌলিক সংকট ও সমস্যাকে এড়িয়ে যান। বেকারত্ব, মাদক কতো মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার বদলে তারা রাষ্ট্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে যেন বেশি আগ্রহী। আবার নারীদের সমস্যা নিয়েও অনেকে সোচ্চার। যদিও একদল ‘লাইফ স্টাইল নারীবাদী’ (কেবল বেশভূষাতে নারীবাদী) বুদ্ধিজীবীও দেশে আছে, তারাও সমাজের মূল সমস্যার দিকে তাকান না। সমাজের এথিকস ও ধর্মকে একতরফাভাবে আক্রমণ করাই যেন বুদ্ধিজীবিতা তাদের কাছে। এদের আবার এনজিওবাদীরা সমর্থনও দেন। এনজিওরা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, সেটা মূলত ফান্ডের স্বার্থে। জনগণের স্বার্থে ততটা নন। ফলে বুদ্ধিজীবীরা জনগণের কাছে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক থাকেন না আমাদের দেশে।
বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে মেট্রোরেলের এক যাত্রীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা এমনভাবে মিথ্যা কথা বলেন যে, শুনলে শিশুরাও লজ্জা পায়। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা এই নাগরিক মনে করেন, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলে যারা নিজেদের মনে করে বা পরিচয় দেয় এদের বেশির ভাগই সুযোগ সন্ধানী।মানবজমিন