এ এন রাশেদা:- ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’—এই দাবি নিয়ে ১৯৫২ সালে যাঁরা শহীদ হলেন, যাঁদের বুকের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হলো, সেই ’৫২-র দাবি, বাংলা ‘রাষ্ট্র ভাষা’ হলেও কার্যত তা অকার্যকরই রয়ে গেল। যদি বলা যায়, অফিস-আদালতের সর্বত্র কি বাংলা ভাষা চালু হয়েছে? নিম্ন আদালতে হলেও উচ্চ আদালতে তা কার্যকর হলো না কেন? মাঝেমধ্যে কিছু ব্যতিক্রম হতে দেখা যায় মাত্র। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া প্রাইভেট ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া হয়? যত দিন পর্যন্ত আমরা উচ্চশিক্ষা বাংলায় করতে না পারব, তত দিন আমরা গণমানুষের কাছাকাছি যেতে পারব না। তাদের কান্না বুঝতে পারব না। দেশের গণমানুষের কাছে উন্নয়ন পৌঁছাতে পারব না।
রাশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপানসহ বহু দেশ যদি মাতৃভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সব উচ্চশিক্ষা মাতৃভাষায় দিতে পারে, বাংলাদেশ পারবে না কেন? ২০১৩ সালে ব্যাংককে এক হাসপাতালে প্রত্যক্ষভাবেই জানার সুযোগ হয়েছিল আমার, সেখানে থাই ভাষায় মেডিকেল ডিগ্রি না থাকলে থাইল্যান্ডের কোথাও চাকরি মেলে না। শুধু নির্ধারিত ডাক্তার ও মেট্রোন বিদেশিদের সঙ্গে আলাপ করেন চিকিৎসা বিষয়ে। এ ছাড়া কেউ একটিও শব্দ উচ্চারণ করে না বা ইংরেজি বলতে পেরে গর্বও অনুভব করে না।
১৯৯৭ সালে ‘বাংলা ভাষা ও আমরা’ নিবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একটি সময়ের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা নিজেদের মধ্যে চিঠি চালাচালি করত ইংরেজিতে। জোড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সকলে সে নিয়ম ভাঙলেন। বাংলা ভাষার ব্যাপকতর প্রয়োগের বিষয়ে তাদের উৎসাহের অন্ত ছিল না। শিক্ষাদান যে মাতৃভাষায় করা দরকার, এ কথা সর্বাগ্রে বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মেজ দাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ওপরেই ভার পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তার সমবয়সীদের শিক্ষিত করে তোলার। তাঁর প্রয়াসের কী ফল দেখা দিয়েছিল তা আমরা জানি। মাতৃভাষায় কেন শিক্ষা দেওয়া দরকার, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং কথার চেয়ে দৃষ্টান্ত শ্রেয়—এই নীতির অনুসরণে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং পরে বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন। আজ থেকে ১০৩ বছর আগের কথা। ১৯২১ সাল রবীন্দ্রনাথ যা ভেবেছিলেন, তা তিনি করেছিলেন।’
আর আমরা ’৫২-তে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এবং ১৯৭১-এ একটি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে সফল হয়েও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মঙ্গলের জন্য তা করতে পারিনি। ইতিমধ্যে আমরা বিত্তবানদের জন্য টেক্সট বুক বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম, ব্রিটিশ, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান নানান কারিকুলামে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা জায়েজ করেছি; অন্যদিকে বিত্তহীনদের জন্য শিক্ষক ছাড়া, শিক্ষকের বেতন ছাড়া বা অর্ধেক বেতনে বাংলা মাধ্যমে অত্যন্ত কায়ক্লেশে ক্লাস চালিয়ে যেতে বাধ্য করছি বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের। সরকারি স্কুল-কলেজেও আছে এ সমস্যা। এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া আদৌ হচ্ছে কি? ভাষা শিক্ষাসহ কোনো শিক্ষাই বেশির ভাগ শিক্ষায়তনে হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে ভিড় করছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই নাকি নতুন কারিকুলাম তৈরি হয়েছে। অথচ নতুন উদ্দেশ্যে, নতুন কৌশলে সেই কোচিংয়ের আবির্ভাবও হয়ে গেছে। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি না করে শুধু কারিকুলাম পরিবর্তন তো শিক্ষার্থীর উন্নয়ন করতে পারবে না।
২০০৮ সালে টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদন মতে, প্রাথমিক শিক্ষা খাতের স্তরে স্তরে দুর্নীতি। এসব সমস্যার মধ্যে শিক্ষকে স্বল্পতা, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া, শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার তুলনায় শিক্ষার্থীর আধিক্য, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার অভাব, বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অর্থের স্বল্পতা, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি ও কল্যাণ সমিতির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতার অভাব, শিক্ষকদের বেতন-ভাতার স্বল্পতা, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে শিক্ষকের হয়রানি, শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগের অভাব, প্রধান শিক্ষকের উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাতায়াতের জন্য ভাতা না থাকা, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে বিদ্যালয়ে বই পরিবহন খরচ বিদ্যালয়ের দূরত্ব অনুযায়ী প্রদান না করা। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার অভাব। প্রাথমিক শিক্ষাবহির্ভূত কাজসহ আরও কিছু ত্রুটি তুলে ধরেছিল টিআইবি। অথচ এসব দূরীকরণের চেষ্টা কি করা হয়েছে দীর্ঘ ১৫ বছরে? হয়নি।
পুরো শিক্ষক সমাজ যখন অবহেলিত? এর প্রমাণ হিসেবে সার্কভুক্ত আটটি দেশের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতনকাঠামোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। যেমন—শ্রীলঙ্কা ৭৫,০০০ টাকা, ভারত ৬৫,০০০ টাকা, মালদ্বীপ ৫৮,০০০ টাকা, পাকিস্তান ৫২,০০০ টাকা, ভুটান ৪৮,০০০ টাকা, আফগানিস্তান ৪৭,০০০ টাকা, নেপাল ৩৮,০০০ টাকা এবং বাংলাদেশ ১৬,০০০ টাকা। এর পরও কি বলবেন কেউ, দেশের শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা দারুণ উন্নত অবস্থায় আছে?
তাহলে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা আছে কোথায়? শিক্ষা তো মুখস্থ বুলি আওড়িয়ে ডিগ্রি পাওয়া নয়। শিক্ষা মানবিক উৎকর্ষ সাধন থেকে চিন্তা চেতনায় অগ্রগতি সাধন। সে-ই শিক্ষিত, যার আলোয় অন্যরা আলোকিত হয়।
বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলায় নয় কেন? তা যে সুবিধাভোগী শ্রেণির শোষণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, শোষিত জনগোষ্ঠীর রক্ত নিংড়ে খাওয়ার জন্য, তাদের জমিজমা, সহায়-সম্পদ, তাদের ব্যবহৃত নদীনালা, খালবিল মহা-উন্নয়নের নামে দখল করে সুবিধা ভোগ করার জন্য—এই সহজ সমীকরণ যত দিন এ দেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষক সমাজ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষ বুঝতে অপারগ হবে, তত দিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা তথা চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি বাংলায় চালু হবে না। তবে ঐতিহাসিক কারণে উচ্চশিক্ষায় যারা যাবে, তাদের ইংরেজি ভাষা হিসেবে শিখতে হবে। প্রাথমিকে তা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। প্রাথমিকের পরে আধুনিক পদ্ধতিতে ভাষা হিসেবে তা অবশ্যই শেখাতে হবে, সকল স্তরে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এবং শিক্ষকদের বিশ্বমানের বেতন স্কেল নির্ধারণ করে। আর বন্ধ করতে হবে সব ধরনের শোষণের যন্ত্র। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নই ছিল শোষণমুক্ত সমাজ।
১৯৮৪ সালে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এক প্রবন্ধে তাই বলেছিলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছি আমরা, তা শুধু একক ও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার সংকট নয়; এর সঙ্গে জড়িত আমাদের কৃষির সংকট, শিল্পের সংকট তথা অর্থনীতির সংকট। আমাদের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত প্রগতিশীল মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়ার ফলে সৃষ্ট সংকট তথা রাজনীতির সংকট। সমাজজীবনে দুর্নীতি, উৎকোচ, নারী নির্যাতন, খুন-রাহাজানি, ছিনতাই, কিশোর অপরাধ প্রভৃতির সংকট তথা সামাজিক সংকট। শিক্ষার সংকট মোচন করতে চাইলে আমাদের সামগ্রিক সংকটের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে হবে এবং জাতীয় ভিত্তিতে সুসমন্বিত ব্যাপক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
কথাগুলো আজও সত্য। শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা প্রবর্তনের জন্য হয়তো প্রয়োজন হতে পারে আর একটা আন্দোলনের। আর যখন প্রতিষ্ঠিত হবে গণমানুষের কাঙ্ক্ষিত শোষণমুক্ত দেশ।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, নটর ডেম কলেজ; সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা, সাপ্তাহিক একতা