ডেস্ক রির্পোট:- স্থাপনা নির্মাণে লঙ্ঘিত সরকারি বিধিবিধান। কেনাকাটা ও দরপত্রে মানা হয়নি নিয়ম। এক খাতের টাকা ব্যয় হয়েছে অন্য খাতে। ঘটেছে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন ও বিধিবহির্ভূতভাবে ভাতা প্রদানের ঘটনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের অসংখ্য অনিয়ম ও অসংগতি উঠে এসেছে নিরীক্ষায়। সেসব অনিয়মের কারণে দেশের ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর, যা উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে।
মোট ৬২০ অডিট আপত্তির মাধ্যমে এ অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। অডিট আপত্তিগুলোও দুই ধরনের। এর একটি সাধারণ, অন্যটি অগ্রিম।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অডিট আপত্তিগুলো দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই গুরুতর আর্থিক অনিয়ম, যা ধরন হিসেবে অগ্রিম উল্লেখ করা হয়েছে। এ আপত্তিগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুপারিশ করেছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, অডিট আপত্তিগুলো নিয়ম অনুযায়ী ইউজিসিতে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসির মাধ্যমে ব্রড শিটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আপত্তির জবাব দেয়। এরপর প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণ পেলে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। নাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে। ওই সময় দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫৩টি। এর মধ্যে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৭৬ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক অনিয়মের তথ্য পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম হয়েছে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার।
গাজীপুরে অবস্থিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে বিভিন্ন অর্থবছরে মোট ২৪টি অডিট আপত্তি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। এসব আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১৭০ কোটি ৩৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে অডিট আপত্তি হয়ে থাকে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর ধারাবাহিকভাবে পুরোনো অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নিয়েছি।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পর টাকার অঙ্কে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে মোট ৪২ অডিট আপত্তি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর, যার অধিকাংশই অগ্রিম আপত্তি। এসব আপত্তিতে জড়িত টাকার পরিমাণ ১৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) মোট ১৩৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকার অনিয়মের কথা বলা হয়েছে ইউজিসির প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ১০টি আপত্তির ধরন অগ্রিম, বাকিগুলো সাধারণ।
এ বিষয়ে বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আপত্তিগুলো নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অডিট আপত্তি উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) নিয়ে। আপত্তির সংখ্যা ৩৫টি। এতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১০০ কোটি ৬০ লাখ ৩৫ হাজার ২০০ টাকা।
এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিতভাবে অডিট আপত্তির জবাব দিচ্ছে। এ ছাড়া সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, এ অডিট আপত্তিগুলো দীর্ঘদিনের। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপত্তিগুলোর জবাব দিচ্ছে। এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত, কঠোরভাবে আর্থিক বিধিবিধান মেনে চলা।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৭টি অডিট আপত্তিতে ৮৫ কোটি ৫৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা অনিয়মের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ কোটি, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ কোটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ কোটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ কোটি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ কোটি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ কোটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ কোটি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ কোটি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ কোটি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ কোটি টাকা অনিয়মের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর বাইরে প্রতিবেদনে আরও ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট আপত্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব আপত্তি অনিয়মের পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়। এখানে অনিয়ম কোনোভাবে সহ্য করা যায় না। সংশ্লিষ্টদের উচিত শিগগিরই এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অডিট আপত্তিগুলোর জবাব সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্রড শিটের মাধ্যমে দিচ্ছে। জবাবে সন্তুষ্ট হলে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।আজকের পত্রিকা