ডেস্ক রির্পোট:- সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই মাস আগে। এখন নতুন কমিটি করার সময়। কিন্তু তা না করে মেয়াদোত্তীর্ণ আংশিক কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগ। গতকাল সোমবার সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
ঘোষিত ২৭৯ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বিতর্কিত অনেকে স্থান পেয়েছেন, যাঁদের নামে চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, হয়রানি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ আছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতা-কর্মীরা। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে সহসভাপতির পদ পাওয়া এক ছাত্রনেতা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কমিটিকে আরও পরিশুদ্ধ করে ঘোষণা করা যেত। কিন্তু শয়ন-সৈকত (ঢাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) এ জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ভালো রাজনীতি করা লোকজন পদ না পেলেও বিতর্কিতরা পদ পেয়েছেন এবার।’
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অনুমোদন নিয়ে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটিগুলো জেলা শাখার মর্যাদা পায়। ঢাবি শাখাও জেলার সমমানের, যার কমিটির মেয়াদ ১ বছর। সেই হিসাবে ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাবি শাখা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা সমমানের কমিটি ১২১ সদস্যের হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রেও গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ। গতকাল সকালে নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢাবি শাখার ২৭৯ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাবি শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত।
এই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি পদে ৬১ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ১১, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ১১, সম্পাদকীয় পদগুলোতে ৩৬ জনকে মনোনীত করা হয়েছে। উপসম্পাদক হয়েছেন ১৩৬ জন; সহসম্পাদক ১০ জন, আর সদস্যপদ পেয়েছেন ১১ জন।
কমিটিতে বিতর্কিতদের ঠাঁই
ঘোষিত কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে সহসভাপতি পদ পেয়েছেন নূর উদ্দিন আহমেদ। গত বছরের ১১ মে মোটরসাইকেল কিনতে আসা এক যুবকের ১০ হাজার টাকা ও ফোন ছিনতাই এবং পরবর্তী সময়ে আরও টাকা নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন নূর। তাঁকে ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর আগে ২০২২ সালে মল চত্বরে শিক্ষার্থীকে মারধর করে টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া বেলায়েত হোসেন রকির বিরুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মোড়ে দোকানে চাঁদাবাজি, দোকান কর্মচারীকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তুলে নিয়ে মারধর, হুমকি ও মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ রয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিজয় একাত্তর হলে এক শিক্ষার্থীকে শিবির কর্মী সন্দেহে রাতভর মারধর করে হলছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে শাহনেওয়াজ বাবু ও ইউসুফ তুহিনের বিরুদ্ধে। বাবুকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। তুহিনকে করা হয়েছে কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক।
গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনকালে টিএসসিতে সংগঠনের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লাসহ নেতা-কর্মীদের মারধরের অভিযোগ রয়েছে শাহনেওয়াজ বাবু ও শাহিরিয়াদ শহীদ শুভর বিরুদ্ধে। শুভকে উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক করা হয়েছে।
২০২১ সালে বার্ন ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ডবয়কে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদার জন্য মারধর; ক্যাম্পাসে মাদকের সিন্ডিকেট, উদ্যানে গাঁজা-মাদক বিক্রি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন আকতারুল করিম লিটন।জেলেও গিয়েছিলেন তিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ঘোষিত কমিটিতে সহসভাপতি করা হয়েছে।
২০১৯ সালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মোবাইল ফোন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন স্বাগতম বাড়ৈসহ বেশ কয়েকজন। পরে সিনিয়ররা তাঁদের পিটিয়ে ফোন উদ্ধার করেন। স্বাগতম বাড়ৈ কমিটিতে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হয়েছেন। ফজলুল হক মুসলিম হলের সিট দখল নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে জড়িয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন জিহাদুল ইসলাম। তাঁকে উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক করা হয়েছে।
৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের ভ্রাম্যমাণ দোকানমালিকের কাছ থেকে চাঁদা চাওয়ার অডিও ক্লিপ ফাঁস হয় তানভীর হোসেন শান্তর। তাঁকে কমিটিতে নাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক করা হয়েছে। গত বছরের ১১ জুন মুহসীন হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান শিবলি সাদিক। এ ঘটনার ছবি তোলায় এক সাংবাদিককে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁকে স্কুলছাত্রবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে ফুল দিতে ঢাবি ক্যাম্পাসে এসে মেহেদী হাসান নিবিড় ও শাহরিয়ার নিরবের হেনস্তার শিকার হন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঢাবি শীর্ষ নেতৃত্বের টানাপোড়েন চলছিল তখন। সেই নিবিড় ১ নম্বর সহসভাপতি এবং নিরব হয়েছেন প্রচার সম্পাদক।
ঘোষিত কমিটির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, গতবার ২৫১ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। এবার সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি, নির্বাচন-পরবর্তী কমিটি হওয়ায় কলেবর বেড়েছে।
বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের পদায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘অনেকে আগে অপরাধ করেছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে ভালো হয়েছে এমন কয়েকজনকে অপরাধপ্রবণতা থেকে ফিরে আসার কমিটমেন্টের কারণে পদ দেওয়া হয়েছে। তারা ভালো হোক, এটা আমাদের চাওয়া।’
এ বিষয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ঐতিহ্য, রীতিনীতি-রেওয়াজ রয়েছে। কমিটি গঠনে রীতিনীতি ও দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।আজকের পত্রিকা