ডেস্ক রির্পোট:- মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও বাংলাদেশের কাছে কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় কারণেই এই রাজ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বের মূলে রয়েছে রাজ্যটির ভূ-কৌশলগত অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রধানত এই কারণে যে, সেখানে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুততর হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূ-কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে প্রতিবেশীসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইন প্রদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজ্যটিতে চীন ও ভারত মেগা প্রকল্প নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। উভয় দেশই রাখাইন রাজ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) স্থাপন করছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও তেল ও গ্যাসের বিশাল রিজার্ভ থাকায় রাজ্যটিকে এসব দেশের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
রাখাইন রাজ্যে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভূমিকা বেশি না হলেও দেশটি দেদার মায়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। এ কারণে দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তেমন কথাও বলে না। মায়ানমারে অস্ত্র বিক্রি না করতে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয় গত বছরের শেষদিকে। সেই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন ও রাশিয়া।
এ প্রসঙ্গে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, কোনো দেশ তো আর রাখাইনে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিচ্ছে না। দেশগুলো এই সংঘর্ষের সুযোগ নিচ্ছে মাত্র।
জানা যায়, রাখাইনে বাংলাদেশের স্বার্থ মূলত প্রতিবেশীসুলভ। অঞ্চলটিতে স্থিতিশীলতা ফিরলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজ হতো। এ ছাড়া ওই সীমান্ত বাংলাদেশি অঞ্চলগুলোর স্থিতিশীলতার জন্যও রাখাইনে স্থিতিশীলতা চায় বাংলাদেশ।
চীনা বিনিয়োগ
রাখাইন রাজ্যের চীনের অন্যতম প্রধান স্বার্থ প্রাকৃতিক সম্পদ। রাজ্যটিতে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন গ্যাসের বিশাল মজুত রয়েছে। ২০০৪ সালে এই মজুত আবিষ্কারের পরপরই চীনের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তারপর ২০০৮ সালে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে মায়ানমারের জান্তা সরকার। রাখাইন থেকে সরাসরি গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশে নিতে পাইপলাইন স্থাপন করেছে বেইজিং। প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
রাখাইনে রয়েছে তেলেরও বড় মজুত। ২০০৮ সালে অপরিশোধিত তেলের পাইপলাইনের চুক্তি করে চীন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর মাত্র চার মাস আগে থেকে এই পাইপলাইনে চীনের ইউনান প্রদেশে তেল সরবরাহ শুরু হয়। চীনের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই রাখাইন রাজ্য।
চীনের সঙ্গে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের মোট ৩৩টি চুক্তিও হয়েছে। চীন রাখাইনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করারও চুক্তি করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী রাখাইনে কিউকফিউ শহরে নির্মিত সমুদ্রবন্দরের ৭০ শতাংশ মালিকানা থাকবে চীনের। বাকি মাত্র ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মায়ানমারের হাতে। রাখাইনের সঙ্গে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের একটি অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তুলছে চীন। এর উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ের সংযোগ ঘটানো। চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চাওকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এই বিশেষ করিডরের অংশ।
চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চীন বিনিয়োগ করছে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ হবে ৭৩০ কোটি ডলার। রাখাইন রাজ্যের চাওকপিউ টাউনশিপের মাদে দ্বীপে ১৫০ হেক্টর ও রামরি দ্বীপে ৯৬ হেক্টর জমিতে এ দুই প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভারতীয় বিনিয়োগ
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব খর্ব করতে মায়ানমারকে কাছে টানছে ভারত। তাই রাখাইনে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। চীন যেহেতু রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর করছে, তাই ভারত চাইছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাখাইনের সিটওয়ে বন্দর প্রকল্পের কাজ। সিটওয়েতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করছে ভারত। ভারতের এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সমুদ্রপথে কলকাতার সঙ্গে রাখাইনের সিটওয়ে (আগের আকিয়াব) সংযুক্ত হবে। ভারত অনেক আগেই এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে সিটওয়ে বন্দর ভারতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনে এ রুটটি ব্যবহৃত হবে। এটা সম্পন্ন হলে নদীপথে সিটওয়ের সঙ্গে মায়ানমারের চিন রাজ্যের পালেটওয়া বন্দরকে সংযুক্ত করবে। এরপর সড়কপথে পালেটওয়া সংযুক্ত হবে মিজোরামের জরিনপুইয়ের সঙ্গে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে একদিকে মায়ানমার-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত সাতরাজ্যে পণ্য পরিবহন সহজ হবে।
ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের প্রায় ১ হাজর ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। বঙ্গোসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। রাখাইনের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ ভারতের নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের লুক ইস্ট (পূর্বমুখী) নীতি বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের স্বার্থ
রাখাইন রাজ্যের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আগ্রহ অঞ্চলটির প্রতি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এ জন্য রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ ছাড়া তারা তেমন উচ্চবাচ্য করে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি রাখাইন রাজ্যে তেল-গ্যাসে বিনিয়োগ করছে। এ সম্পর্কে ড. এ কে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে প্রায়ই অভিযোগ করে বলতেন, এসব প্রভাবশালী দেশ রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিধনে অভিযুক্ত মায়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা বাড়িয়েছে ১৫ থেকে ২০০ গুণ পর্যন্ত। যদিও দেশগুলো মায়ানমারের কয়েকজন জেনারেলকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
ব্যবসা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে রাখাইন রাজ্য ঘিরে। দেশটি ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। তা ছাড়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যেহেতু রাজ্যটিতে সক্রিয় কাজেই যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র চায় এই অঞ্চলে তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়ন করতে এবং এশিয়ার ন্যাটো বলে পরিচিত কোয়াডের বিস্তার।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, কোয়াড পুরোপুরি চীনবিরোধী জোট। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা আগের ভারতের চোখ দিয়ে এই অঞ্চলকে দেখত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। তারা সরাসরি এই অঞ্চলে সম্পৃক্ত হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত প্যাসিফিকের মতো ভারত মহাসাগরে তার সরাসরি উপস্থিতি বাড়াতে। যেটি হয়তো ভারত পছন্দ নাও করতে পারে। খবরের কাগজ