পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল,১০ বছরে খুন সাড়ে চার শতাধিক

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ২৯১ দেখা হয়েছে

রাঙ্গামাটি:- সবুজ পাহাড় মাঝে মাঝেই রঞ্জিত হচ্ছে রক্তে। থামছেই না খুন-খারাবি। পাহাড়ে আঞ্চলিক চারটি সংগঠনের ভাতৃঘাতী সংঘাতে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। হত্যার বদলা নিতে একের পর এক ‘টার্গেট কিলিং’-এর শিকার হচ্ছেন পাহাড়ি লোকজন। স্বগোত্রের পাহাড়ি অস্ত্রধারীদেরই ‘ঘাতক’ হিসেবে দায়ী করছে সংগঠনগুলো।

তবে বরাবরই এসব হত্যাকাণ্ডের দায় প্রতিপক্ষের ওপর চাপানো এবং অস্বীকারের রীতি থেকে বের হতে চাইছে না কেউই।

মূলত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার, মতের ভিন্নতা আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ছে এসব সংগঠন। আবার পাল্টা ‘প্রতিশোধ’ নিতেও খুন করা হচ্ছে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের।

রবিবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে রাঙ্গামাটির সাজেকের মাচালংয়ের ব্রিজপাড়ায় দুজনকে গুলি করেছে প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। নিহতরা হলেন আশুক্য চাকমা আশিষ (৪৫) ও দিপায়ন চাকমা (৩৮)। বাঘাইছড়ি রুপাকারি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড মোরঘোনা গ্রামের মৃত শান্তিকুমার চাকমার ছেলে আশিষ চাকমা। আর দিপায়ন চাকমা সাজেক ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড উত্তর এগুজ্জ্যাছড়ি গ্রামের মৃত অনিল বরণ চাকমার ছেলে।

রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। গুলিতে নিহত দুজনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে আগামী ১০ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের অবকাশ যাপনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাজেক ভ্রমণের কথা রয়েছে। এই ভ্রমণসূচির মাত্র চার দিন আগে সন্ত্রাসীদের এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে খতিয়ে দেখছে স্থানীয় প্রশাসন।

নিহত দুজনকে নিজেদের দলের সদস্য বলে দাবি করেছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন প্রসিত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফের রাঙ্গামাটি জেলা সংগঠক সচল চাকমা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের প্রতিপক্ষ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তবে এ দায় অস্বীকার করেছে সন্তু লারমার জেএসএস। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা বলেন, সাজেক এলাকায় জেএসএসের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। ইউপিডিএফের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ইউপিডিএফের চার নেতাকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। গত ১১ ডিসেম্বর পানছড়ির অনিলপাড়ায় প্রসিতপন্থি ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পিসিপির সাবেক সভাপতি বিপুল চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহসভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফের সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপকে দায়ী করে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ।

গত ২৪ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার দুর্গম দূরছড়ি এলাকায় প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের সদস্য রবি কুমার চাকমা (৬৪) ও শান্ত চাকমা বিমলকে (৫৫) গুলি চালিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা। অপহরণ করা হয় রহিন্তু চাকমা টিপন (৩২) নামের আরেক সদস্যকে। তবে এসব হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ি এলাকায় কয়েক দফা বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হয় আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে। সেসব ঘটনায় স্থানীয়ভাবে হতাহতের তথ্য পাওয়া গেলেও কোনো পক্ষ থেকেই দায় স্বীকার করা হয়নি।

অভিযোগ আছে, নানা ধরনের উৎস থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে আসছে আঞ্চলিক দলগুলো। এসবের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তারে নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে প্রাণহানির পরিসংখ্যান নেই কারও কাছেই। তবে গণমাধ্যমে আসা তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত গত ১০ বছরে পাহাড়ি তিন জেলায় খুন হয়েছেন সাড়ে চার শতাধিক মানুষ। অপহরণের শিকার সাড়ে ৫০০-এর বেশি। এ ছাড়া প্রসিতপন্থি ইউপিডিএফের ৩৬০ জন, সংস্কারপন্থি জেএসএস (এমএন লারমা) দলের ৮৩ জন খুন হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে।

পাহাড়ে সরকারি অফিসে ঢুকে গুলি, ইউপি সদস্য নিহত

‘পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়’ আর চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ‘দৃশ্যমান দাবি’র আড়ালে পাহাড়ে এখন সক্রিয় ছয়টি আঞ্চলিক সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসিত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং সদ্য জন্মানো কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আলাদা ‘জোট’ করে সংঘাতে জড়িয়ে আছে।

সন্তু লারমার ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাহাড়িদের মূল সংগঠন সন্তু লারমার জেএসএসের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। মাঝখানে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বছর তিনেক পার্বত্যাঞ্চলের কোথাও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ব্যাপক আলোচনা আছে যে এ সময়ে পাহাড়ের তিন আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু লারমা), প্রসিতপন্থি ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারের (এমএন লারমা) মধ্যকার ‘অস্ত্রবিরতি’ চলছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামে আরেক আঞ্চলিক পাহাড়ি সংগঠনের আত্মপ্রকাশের পর এই ‘সমঝোতা শান্তি’তে ছেদ পড়ে।

২০১৮ সালের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংস্কারবাদী জেএসএসের সহসভাপতি শক্তিমান চাকমাকে হত্যা ও পরদিন ৪ মে তার শেষকৃত্যে অংশ নিতে আসা গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফপ্রধান তপনজ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা ও আটজনকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার জন্য দল দুটি প্রতিপক্ষ প্রসিতপন্থি ইউপিডিএফকে দায়ী করে আসছে। এ ছয় হত্যাকাণ্ডের ‘প্রতিশোধ’ নিতেই এর সাড়ে তিন মাসের মাথায় ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়িতে প্রসিতপন্থি ইউপিডিএফের সাতজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় বলে আলোচনা আছে।

এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠা সশস্ত্র এই অপতৎপরতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রায়ই আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়ে পড়ে। নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার সঙ্গে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় আর চাঁদাবাজির ঘটনায় অস্থির হয়ে ওঠে পাহাড়ের পরিস্থিতি।

প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের দাবি, ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিপক্ষের হাতে সংগঠনটির ৩৬০ জন নেতা-কর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সন্তু লারমার জেএসএসের হাতে ৩০২ জন এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা) গ্রুপের হাতে ৫৮ খুন হয়েছেন।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্বে থাকা নিরন চাকমা এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফ নেতা হত্যার ঘটনাকে কাপুরুষোচিত ও ন্যক্কারজনক আখ্যায়িত করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে ইউপিডিএফের চলমান আন্দোলন বানচাল করে দেওয়ার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সন্তু গ্রুপ সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত ইউপিডএফ নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। সুত্র খবরের কাগজ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions