শিরোনাম
শিক্ষার্থীদের পরিকল্পিতভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে ঢাকা-দিল্লি পররাষ্ট্রসচিব বৈঠক ডিসেম্বরে, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনা হবে কি এবার মারা গেলেন পরীমণির প্রথম সিনেমার পরিচালক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ, বদিউল বললেন, ‘বিবেচনায় রয়েছে’ বান্দরবানে নৌকা বাইচ দিয়ে ক্রীড়া মেলা শুরু রাঙ্গামাটিতে সাফজয়ী পাহাড়ের তিন কন্যাকে উষ্ণ সংবর্ধনা পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, মামলার প্রস্তুতি শেখ মুজিব দেশে ফ্যাসিবাদের জনক : মির্জা ফখরুল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীর হাতে পিটুনি

জাতীয় পার্টি: ভাঙনের শব্দ শুনি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ২০২ দেখা হয়েছে

মহিউদ্দিন খান মোহন:- ১৯৮৩ সালের কথা। সে সময় বিটিভিতে প্রচারিত একটি দর্শকপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়েছিল ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’। সেলিম আল দীন রচিত এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রযোজিত সেই নাটকে ‘সেরাজ তালুকদার’ নামের এক গ্রাম্য মাতব্বরের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। কীভাবে অন্যের জমি গ্রাস করা যায়, এটা ছিল তাঁর প্রধান ভাবনা ও কাজ।

ওই নাটকে হুমায়ুন ফরীদির একটি সংলাপ তখন সবার মুখে মুখে ফিরত। সংলাপটি ছিল—‘আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি।’ নদীভাঙনের পর চর জেগে উঠতে শুরু করলেই সেরাজ তালুকদারের ‘পানি কেনার চেতনা জেগে উঠত। মূলত নদীভাঙন এবং সে কারণে সৃষ্ট নানা সামাজিক সংঘাত ছিল নাটকটির মূল উপজীব্য।

ভাঙন এই জগৎ-সংসারে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। চলমান সময়ে বাতাসে কান পাতলে নানা কিসিমের ভাঙনের শব্দ শোনা যায়।কোথাও ভাঙছে সংসার কিংবা সামাজিক বন্ধন, কোথাও মানুষের মন। সর্বনাশা ভাঙনের এই করালগ্রাসে বিলীন হয়ে যাচ্ছে কত সংসার, মূল্যবোধ আর প্রথা। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের মতো ভাঙন তার কালো থাবা বিস্তার করে আছে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনেও।

সেখানে প্রায়ই শোনা যায় ভাঙনের গর্জন। আজ এ দল ভাঙছে তো কাল সেই জোট ভেঙে যাচ্ছে। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় দেশের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অবয়ব লাভ করছে। কোনো কোনোটি হয়ে গেছে বিলীন। যেমন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ভাঙতে ভাঙতে দলটি এখন প্রায় অস্তিত্বহীন। স্বাধীনতার পর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেই আবির্ভূত হয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।

নেতৃত্বের কোন্দল-কলহ দলটিকে করেছে বিপর্যস্ত। জাসদ থেকে জন্ম নিয়েছে বাসদ। সেই বাসদ হয়েছে একাধিক টুকরো। আজ জাসদ এত বিভক্ত যে কোনটা মূল জাসদ, তা ঠাহর করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ভাগ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিও। এর থেকে জন্ম নিয়েছে নানা নামের বামপন্থী রাজনৈতিক দল। মজার ব্যাপার হলো, দলগুলো একই আদর্শের কথা বললেও তারা এক হতে পারে না। আদর্শ আর লক্ষ্য যদি এক হয়, তাহলে দলগুলো কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না, এ এক রহস্যময় ব্যাপার। সেই রহস্যের উন্মোচন আমার মতো স্বল্প জ্ঞানী আর স্থূলবুদ্ধির মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও একটি ভাঙনের আলামত বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর এই ভাঙনের কবলে পড়তে যাচ্ছে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টি। দলটি এর আগেও কয়েকবার ভেঙেছে। সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জেপি, ইত্যাদি বাই-প্রোডাক্ট। এরশাদের লোকান্তরের পর মূল জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন দেবর-ভাবি—রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। এই দুজনের মধ্যে নেতৃত্বের সংঘাত এরশাদ জীবিত থাকতেই শুরু হয়েছিল, তবে এতটা প্রকট রূপ ধারণ করেনি। এরশাদের মৃত্যুর পর ভাবি রওশন এবং দেবর জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে, দল প্রায় ভেঙে যায় যায় অবস্থায় উপনীত হয়েছিল।

অসুস্থ রওশন এরশাদ শেষ পর্যন্ত দেবর জি এম কাদেরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুবিধা করতে পারেননি, সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে ভেতরে-ভেতরে দ্বন্দ্ব তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে। রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হয়েও পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে আনতে পারেননি। শেষতক নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে রওশন গ্রুপ বাদ পড়ে। এমনকি এরশাদপুত্র সাদও পাননি মনোনয়ন। ২৮৩ আসনের প্রায় সবগুলোতেই কাদেরপন্থীরা টিকিট পায়।

রংপুরের একটি আসন অবশ্য রওশন এরশাদের জন্য খালি রাখা হয়েছিল, তবে তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি। ফলে রওশনবিহীন জাতীয় পার্টি বানাতে পেরে একরকম স্বস্তি অনুভব করেছিলেন জি এম কাদের। কিন্তু তাঁর সেই স্বস্তি খুব একটা দীর্ঘায়িত হতে পারেনি।

নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি তাঁকে উপনীত করেছে ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। একদিকে সংসদে তাঁর দল প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি পাবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। সেটা না হলে তিনি হতে পারছেন না বিরোধীদলীয় নেতা। অন্যদিকে দলের এই বিপর্যয়কর ফলাফলের সব দায় চেপেছে তাঁর এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর ওপর। দলের নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ রীতিমতো তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছে। দলের এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া জি এম কাদেরের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, বলা মুশকিল।

ভাবি রওশনকে কোণঠাসা করে দলের নেতৃত্ব বেশ ভালোভাবেই বগলদাবা করতে পেরেছিলেন জি এম কাদের। মনোনয়নের ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন তাঁর শক্তিমত্তা। রওশনপন্থী কাউকেই দেননি মনোনয়নের চিঠি। এরপর সরকারের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির দর-কষাকষিতেও বেশ সুবিধা করতে পেরেছিলেন। বাগিয়ে নিয়েছিলেন ২৬টি আসন। কিন্তু বিধিবাম। ২৬ আসনে সরকারপক্ষ ছাড় দিলেও নির্বাচনে ঘটে ভাগ্যবিপর্যয়। সাকল্যে ১১টি আসনে জয়ের মুখ দেখেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। ভোটের লড়াইয়ে এমন লেজেগোবরে ফলাফল ক্ষুব্ধ করে তুলেছে দলটির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের।

যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা বনানীর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘেরাও এবং চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন। এমনকি তাঁরা চেয়ারম্যান-মহাসচিবের বিরুদ্ধে গোপন সূত্রে অর্থপ্রাপ্তি এবং সেই অর্থ প্রার্থীদের মধ্যে বিতরণ না করে আত্মসাতেরও অভিযোগ তুলেছেন। অবশ্য মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এর প্রতিবাদ করে ১৫ জানুয়ারি বলেছেন, ‘চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের কোনো লোক যদি বলতে পারে আমি বা চেয়ারম্যান কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, তাহলে পদত্যাগ করব।’ এর এক দিন পর একটি দৈনিককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের অভিযোগ অস্বীকার করে সরকারের কাছ থেকে অর্থপ্রাপ্তির অভিযোগকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন।

এদিকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই জাতীয় পার্টিতে শুরু হয়েছে বহিষ্কার। নেতা-কর্মীদের উসকানি দিয়ে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ইন্ধনের অভিযোগে কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ ও ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা। ফলে জাতীয় পার্টি নিশ্চিত ভাঙনের দিকে যাত্রা করেছে—এমন ধারণা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের। এরই মধ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নেতৃত্বে দলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা একটি সভাও করেছেন।

বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-কোন্দলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন-বিতর্ক। চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নিজ নিজ সহধর্মিণীকে ভাগে পাওয়া দুই নারী আসনে মনোনয়ন দিতে চান। এ নিয়ে দলটির অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে নতুন সংঘাত।

রাজনীতি-অভিজ্ঞ মহলের মতে, চলমান দ্বন্দ্ব-কোন্দল যদি দ্রুত নিরসন না হয় তাহলে জাতীয় পার্টি আরেকটি নিশ্চিত ভাঙনের দিকে এগিয়ে যাবে। জি এম কাদের-মুজিবুল হক চুন্নু বলয়ের বাইরে থাকা নেতা-কর্মীরা রওশন এরশাদকে কেন্দ্র করে একত্র হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টি অনেকটাই গৌণ হয়ে পড়বে। এমনকি তাদের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ারও তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions