ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে সম্প্রতি যেসব তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্ধকার ও নিদর্শনময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একসময় যিনি গণতন্ত্রের রক্ষক এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির রূপকার হিসেবে প্রশংসিত ছিলেন, এখন তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে শান্তিকালীন অন্যতম নৃশংস দমন-পীড়নের সরাসরি নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত। যাচাইকৃত অডিও রেকর্ডিং এবং ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনা নিজে ছাত্র-আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রথমে সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন দিয়ে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তা দ্রুতই জাতীয় অভ্যুত্থানে রূপ নেয়- যা বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার গভীর অসঙ্গতিগুলো উন্মোচন করে দেয়। পরবর্তী দমন-পীড়ন কোনো স্থানীয় প্রশাসনের ভুল হিসাব ছিল না; বরং এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সহিংসতার একটি সমন্বিত, উপরের দিক থেকে পরিচালিত প্রয়োগ। অনেক হিসাব অনুযায়ী, এতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন। এই স্বৈরতান্ত্রিক অধঃপতন হঠাৎ ছিল না।
গত এক দশকে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করেছেন এবং নজরদারি, সেন্সরশিপ ও নির্বিচার গ্রেফতারের মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করেছেন। ৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ- যা আন্দোলনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন বলে বিবেচিত, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি ছিল বহু বছরের স্বৈরতন্ত্রের পরিণত প্রকাশ। একধরনের ‘গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট’-এর আড়ালে চলছিল এসব।
গত বছরের এই হত্যাযজ্ঞ এখনো বাংলাদেশের তরুণদের মনে তীব্র ক্ষতের মতো বেঁচে আছে। অনেকেই তাদের বন্ধুদের প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন। শুধুমাত্র ন্যায্যতা, মর্যাদা এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা দাবি করায় তাদের গুলি করা হয়েছে। এমনকি যখন এই গোপন রেকর্ডিংগুলো আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলছে, তখনও হাসিনার দল দাবির পক্ষে অটল। তাদের ভাষায়, এসব পদক্ষেপ ‘উপযুক্ত ও সৎনিয়তে’ নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু প্রমাণগুলো ভিন্ন কথা বলছে:
– সামরিক গ্রেডের অস্ত্র হাতে পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গুলি চালায়।
– ফরেনসিক ভয়েস-ম্যাচিংয়ে শেখ হাসিনার কণ্ঠ শনাক্ত হয়, যেখান থেকে নির্দেশ এসেছে।
– সরকারের নজরদারি অবকাঠামো ব্যবহার করে বিরোধীদের গতিবিধি মনিটর ও দমন করা হয়েছে।
এই ঘটনার প্রভাব শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এক তীব্র প্রশ্ন তোলে- একটি শক্তিশালী, প্রতিষ্ঠিত সরকার যদি নিজ দেশের জনগণের ওপর এভাবে সহিংসতা চালায়, তাহলে বিশ্ব কী ভূমিকা পালন করবে?
এই সংকটে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরও এখনো সুস্পষ্ট আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত বর্বরতার একটি জাতীয় বিচারের মধ্য দিয়েও তা নির্ধারিত হবে।
এই বিচার প্রতিশোধের জন্য নয়- বরং নিশ্চিত করার জন্য যে ভবিষ্যতে আর কোনো জনপ্রিয় বা উত্তারাধীকারি নেত্রী ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন। ঢাকা শহরে যখন ইতিহাস রচিত হচ্ছে, তখন গোটা অঞ্চলকে সতর্কভাবে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের যত কথাই বলা হোক, একটি রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক, তার প্রকৃত মাপকাঠি হলো- সাধারণ মানুষ যখন প্রতিবাদ করে, তখন সরকার তাদের প্রতি কেমন আচরণ করে। সেই পরীক্ষায় শেখ হাসিনা ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। (দ্য স্টেটসম্যানের অনুবাদ)