ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে এসেছে নতুন গতি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫
  • ৪৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর করেছেন চীনে। এই সফরে ড. ইউনূসের বৈশ্বিক পরিচিতির সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে এসেছে নতুন গতি। সফরে গুরুত্ব পেয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সফরে ড. ইউনূসের প্রস্তাব অনুযায়ী আগের ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে চীনের মনোভাব ইতিবাচক। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও চীনা প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানান্তরের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারবে।

তবে তিস্তা প্রকল্পের মতো সংবেদনশীল প্রকল্পে চীনকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে, যার ফল ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে, তা বুঝতে সময় প্রয়োজন। কারণ এ প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার বড় বিরোধিতাকারী ভারত। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের জন্য লাভজনক। তবে বিআরআইতে বাংলাদেশকে যুক্ত করে চীন কতটুকু সুফল পাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বিআরআই প্রসঙ্গে এক কূটনীতিক বলেন, এটি কানেকটিভিটি-সংক্রান্ত প্রকল্প। এর মাধ্যমে আগের যে সিল্ক রুট রয়েছে, তার সঙ্গে দেশগুলোকে যুক্ত করতে চায় চীন। মিয়ানমার হয়ে যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে চীন, তবে এখান থেকে বের হয়ে পশ্চিমে যাওয়ার পথ একমাত্র ভারত। কিন্তু ভারত চীনের এ প্রকল্পের বিরোধী। তাই ভারত বিআরআইয়ে যুক্ত না হলে এর সুফল পেতে বেগ পেতে হবে। এ ছাড়া দরকষাকষিতে বাংলাদেশের যে শক্তি, তা বিআরআইতে প্রয়োগ করতে পারবে না।

এর বাইরে বৈশ্বিক রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে চীনা প্রেসিডেন্টের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগের (জিডিআই) প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জিএসআই) এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগের (জিসিআই) গুরুত্বকেও আমলে নিয়েছে ঢাকা।

ড. ইউনূস এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এর আগে গত ১০ জুলাই দুই দেশের যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে– চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাইওয়ান চীনের অংশ। চীনের মূল স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন করে। একই সঙ্গে চীনের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করে বাংলাদেশ।

তবে কূটনীতিকরা বলছেন বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী যে কোনো স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে থাকবে ঢাকা। তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ড. ইউনূসের বৈশ্বিক পরিচিতি চীন সফরে বাংলাদেশের স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশের স্বার্থকে তুলে ধরা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির। তিনি বলেন, চীন ও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভূকৌশলগত বিষয়ে চীনের সম্পৃক্ততা বেশ গভীর। সে প্রেক্ষাপটে এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা এবং নতুন গতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই এ সফরের ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে। চীন বৃহৎ শক্তি। তাদের পেশাগত দক্ষতা ও সক্ষমতা বাংলাদেশের থেকে অনেক বেশি। তাই তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেরও সে মানের প্রস্তুতি প্রয়োজন।

তিস্তা প্রকল্পে চীনকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এর জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক পুঁজি প্রয়োজন। সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হচ্ছে তিস্তা। অবশ্যই এটি বাড়তি গুরুত্ব পাবে। কারণ বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক, কৌশল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চীন থেকে নিলেও কোনো না কোনো পর্যায়ে সামগ্রিক পানি প্রবাহ ও ব্যবস্থাপনায় ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।

এক চীন নীতিতে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা নিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, এক চীন নীতিতে বাংলাদেশ রয়েছে আগে থেকেই এবং সে অনুযায়ী কাজও করে, সেটি আমাদের অবস্থান। তবে তাইওয়ান নিয়ে যে অবস্থান নেওয়া হয়েছে, এটি একটু বেশি সামনে এগিয়ে গিয়েছি। কারণ তাইওয়ানের স্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো আলোচনা হয় না। মনে হয় ভবিষ্যতে অনেক প্রশ্ন তৈরি করবে।

প্রধান উপদেষ্টার সফরে চীন সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মোট ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ৩০টি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে, যা প্রধান উপদেষ্টা চীনের বেসরকারি খাতের প্রতি বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসেছে। চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় ড. ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বাংলাদেশে চীনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের জন্য ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট শি নিশ্চিত করেন যে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বৈচিত্র্যময় করতে চাইলে বাংলাদেশে স্থানান্তরের জন্য তিনি উৎসাহিত করবেন।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, সম্পর্ক ভালো রেখে বড় শক্তির সঙ্গে উইন-উইন দরকষাকষি সম্ভব, সেটি এ সফরে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয় এসেছে। একই সঙ্গে চীনও তার জাতীয় স্বার্থ ‘এক চীন নীতি’ নিয়ে বাংলাদেশের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল, তা ড. ইউনূসের মাধ্যমে আবারও পূরণ করতে পেয়েছে। তাইওয়ান ইস্যুতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দলগুলো মেনে চলবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, বিআরআইয়ে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ চীন গ্রহণ করবে। এতে বাংলাদেশে বড় ধরনের বৈদেশিক বিনিয়োগ আসা সম্ভব।

পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাহাব এনাম খান বলেন, পানি নিয়ে দুই দেশের একটি মতৈক্য হয়েছে। ভবিষ্যতে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চীনের বড় ভূমিকা দেখা যাবে। তিস্তা প্রকল্প, বিআরআইসহ আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে সফরে প্রভাব নিয়ে এ অধ্যাপক বলেন, এ সফরকে তৃতীয় পক্ষের নজরে না দেখা মঙ্গলজনক। কারণ বাংলাদেশে অর্থনীতি যদি সচল, উন্নয়ন ও টেকসই হয়, তবে তার সফল আঞ্চলিক দেশগুলো সরাসরি পাবে। ফলে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক যদি শুধু ভূকৌশল বা ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় আঞ্চিলক দেশগুলো দেখে তাহলে তা তাদের পররাষ্ট্র নীতির দুর্বলতা। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক, এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বা স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার মতো কোনো উপাদন নেই। তাই ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে শুধু সামরিক বা ভূকৌশলগতভাবে না দেখা উচিত।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, এক বছরের কম সময়ের মধ্যে চীনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দুটি সফর হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার সফর নিয়ে তুলনার বিষয় রয়েছে। স্বাগতিক দেশ চীন ড. ইউনূসের সফরটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে একটা নতুন ভারসাম্য তৈরির প্রচেষ্টা এই সফরে দেখা গেছে।সমকাল

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions