ডেস্ক রির্পোট:- তাছনিমুল হক ফরাজি ওরফে তাছনিম। কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জালালাবাদ ইউনিয়ন ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কমিটির সদস্য। গত বছরের ৪ আগস্ট জেলার ঈদগাঁও বাসস্টেশনে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবল চাকমা, থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমার উপস্থিতিতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। যেখানে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় এই আওয়ামী লীগ নেতা। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলেও তাছনিমকে গণপিটুনি দেয় জনতা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে চিকিৎসা নেয় এই সন্ত্রাসী। পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হলে এক পর্যায়ে নিজেকে ‘বিপ্লবী’ দাবি করে আর্থিক সহায়তা পেতে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আবেদন করে। গত ৬ মার্চ জেলা প্রশাসক তার হাতে অনুদানের চেক তুলে দেন। এরপর বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে পরবর্তীতে তার অনুদান স্থগিত করা হয়।
অন্যদিকে গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ধর্ষণের অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যায় সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন ও সাঈদ আরাফাত শরীফ নামের দুই যুবক। তবে তাদের দুজনকে ‘জুলাই বিপ্লবে নিহত’ দাবি করে আবেদন করে পরিবার। পরে কাগজপত্র, ঘটনার বর্ণনা শুনে প্রতারণার বিষয়টি ধরতে পারেন ফাউন্ডেশনের তদন্তকারীরা।
শুধু তাছনিম, ইয়াছিন ও শরীফই নয়; বরং জুলাই বিপ্লবে হতাহত না হলেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আর্থিক সহায়তা পেতে ফাউন্ডেশনে আবেদন করেছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে অনেকেই অনুদান পেয়েছে। যেসব প্রতারককে শনাক্ত করা গেছে, তাদের অধিকাংশকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলাও হয়েছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ আমার দেশকে বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে ১০ থেকে ১২ জন প্রতারক ধরা পড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা ১০০ থেকে দেড়শ হয়ে যেতে পারে। সহায়তা নিয়েছে কিন্তু পরে শনাক্ত হয়েছে যারা, তাদের কাছ থেকে অর্থ ফেরতের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নাম ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যাদের সন্দেহ হচ্ছে, তাদের প্রথমে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।’
মীর মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সব থেকে বড় সমস্যা আন্দোলনে আহত যোদ্ধারা যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, অনেকেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে রাজি ছিলেন না, যার কারণে এখন তাদের পরিপূর্ণ তথ্য পেতে সমস্যা হচ্ছে। যে নামে ভর্তি হয়েছে, আসলেই তিনি আন্দোলনের কি নাÑ সেটি নিশ্চিত হতে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এখনো অনেক আহত ও শহীদ পরিবার রয়েছে, যারা সরকারের গেজেটের বাইরে রয়েছে। নতুন করে তাদের গেজেটভুক্ত করার দাবি জানানো হবে।’
ছয় হাজার শহীদ-আহত পরিবারকে ৯৭ কোটি টাকা সহায়তা
সরকারের গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত ৮৩৪ জন শহীদ হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ১২ হাজার ৪৯ জন। নতুন করে আরো ৩৫ জন শহীদ ও ৬ শতাধিক আহত ব্যক্তিকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। তাদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী স্নিগ্ধ জানান, গত ২৭ মার্চ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৪১ শহীদ ও আহত পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৪৫ শহীদ পরিবারকে ৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং পাঁচ হাজার ৫৯৬ আহত ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে ৫৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি শহীদ পরিবারকে নমিনি-সংক্রান্ত জটিলতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অনুদান দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ভুয়া আবেদন ৬০টি, ২৪ জনকে মামলা-মুচলেকা
ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সহায়তা পেতে আবেদন করেছে ৬০ জন। এর মধ্যে চারজনের ব্যাপারে গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা থানায় মামলা করেছে পুলিশ। অপরাধ প্রমাণিত হলেও মানবিক কারণে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ২০ জনকে। আরও বেশ কিছু আবেদন এমন সন্দেহে ঝুলে রয়েছে। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
গত ২০ মার্চ জুলাই ফাউন্ডেশনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ১০ থেকে ১২ জন আহতের ভিড়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিএসএমএমইউতে ভর্তি থাকা দুজনকে জিজ্ঞাসাবদ করা হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর একজনকে বের হতে দেখা যায়। জানতে চাইলে ইয়াসিন আরাফাত নামের ওই যুবক নিজেকে আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে আহত হওয়ার দাবি করেন। কিন্তু তার পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও দেখা যায়নি। এ সময় অন্যান্য উপস্থিত আহতরা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, ‘ইয়াসিন বিপ্লবে আহতের কথা বলে ভর্তি হলেও আসলে সে দাঁতের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। তার সঙ্গে সম্রাট নামে আরো একটি ছেলে রয়েছে। তারা চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন সময় অন্যদের উসকে দিত।’
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পাবলিক রিলেশন অ্যান্ড মিডিয়া এক্সিকিউটিভ মো. জাহিদ হোসাইন আমার দেশকে বলেন, ‘প্রতিদিনই দু-তিনজন ভুয়া আবেদনকারী ধরা পড়ছে। প্রতারকরা সবাই শারীরিকভাবে বিভিন্নভাবে ক্ষত নিয়ে আসা। তদন্তে দেখা গেছে, কেউ ডাবগাছ থেকে পড়ে, কেউবা আবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। এমনকি বিপ্লবেই অংশ নেয়নি; উল্টো বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারাও আবেদন করেছে।’
মো. জাহিদ হোসাইন আরো বলেন, ‘সমস্যা হলো আমরা ইচ্ছে করলেই কারো বিরুদ্ধে যাচাই-বাছাই ছাড়া শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারি না। তারপরও ২০ জনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। একইসঙ্গে ভুয়া শনাক্ত হলেই তাদের নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে কী পরিমাণ প্রতারক আবেদন করে সুবিধা নিয়েছে, তা এখনো আমাদের অজানা।’
শহীদ শতাধিক পরিবারের আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘মূল সমস্যা পারিবারিক কলহ। এটা আমাদের জন্য আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল না, অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী আলাদা ছিলেন। আবার কারো শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে স্ত্রীর দ্বন্দ্ব। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। তবে যাদের সন্তান আছে, আমরা তাদের প্রাধান্য দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে শহীদ পরিবারের অনুদানের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে বাবা-মাকে এক লাখ, স্ত্রীকে এক লাখ, আর সন্তানের নামে দেওয়া হচ্ছে তিন লাখ টাকা।’
প্রতারক বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে
জুলাই ফাউন্ডেশনে সহায়তা পেতে যেসব প্রতারক আবেদন করেছে, তাদের বেশিরভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এ ছাড়া গাজীপুর, নরসিংদীর পাশাপাশি রয়েছে ঢাকার বাইরের ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষও।
ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলেন, শুরুর দিকে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে দুর্বলতা থাকায় অনেকেই সেই সুযোগ নিয়েছে। এ জন্য প্রতিটি জেলায় দুজন করে ডিস্ট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটর নেওয়া হয়েছে। তারা তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন।
জুলাই ফাউন্ডেশনের আইন কর্মকর্তা আফরিন পায়েল আমার দেশকে বলেন, ‘মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেড়েছে। আন্দোলনে আহত নয়, এমনকি আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পরও নিজেকে বিপ্লবের পক্ষের লোক সাজিয়ে সহায়তা নিচ্ছে, এখনো আবেদন করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগ জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তথ্য নিয়ে যুক্ত করে। যাচাই-বাছাই করে তথ্যগুলো যুক্ত করার কথা। আমাদের ধারণা, তাদের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপনা করে প্রতারণাগুলো করা হচ্ছে। এ জন্য আমাদের এখানে আবেদন এলে পুনরায় তদন্ত করি আমরা। এমনও দেখা গেছে, মাথায় মুরগির রক্ত লাগিয়ে সেটাকে জুলাই বিপ্লবে আহত দাবি করে টাকা নিতে এসেছে।’
এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখনো শতাধিক আবেদন আছে, যেগুলো অসম্পূর্ণ। এমনকি এক ঠাকুরগাঁও জেলাতেই ১৯৯টি সহায়তার আবেদন এলেও ১৫৬টিতেই অসম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানেও প্রতারণামূলক আবেদন থাকতে পারে বলে আমরা সন্দেহ করছি। তাদের তথ্য সঠিকতার ব্যাপারে সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জেলা প্রশাসনকেও চিঠি দেওয়া হবে।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, সিভিল সার্জনের কাছে যে তথ্যটা যায়, সেখানেই ভালোভাবে যাচাই হওয়া উচিত। যারা ধরা পড়ছে, তাদের টাকা ফেরত নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা থাকলেও সমস্যা হলো গেজেট থেকে নাম বাদ দেওয়া। এটা তো স্বীকৃতি, তাই গেজেট থেকে নাম বাদ দিতে হবে। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও জানান তিনি।আমারদেশ