মোস্তফা কামাল:- কোনো ডেভিল যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, কড়া নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। পুলিশ বলছে, কাউকে ছাড়া হবে না। কড়া নজরদারি রয়েছে এদের ওপর। বাস্তবতা হলো মার্কা মারা পেশাদার ডেভিলরা দেশে বা বিদেশে, কারাগারে বা কারামুক্ত যেখানেই থাকুক তারা দুর্দান্ত পরাক্রমশালী। এ কারণে দেখা যায়, জেলে থাকলে বা বিদেশ পলাতক থাকলেও তাদের বোতাম টেপায় প্রায় সব কাজই চলে। এমনকি তাদের কারও মৃত্যু হলেও সেকেন্ড বা থার্ডম্যান তার যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম চালিয়ে নেয়। বরং কখনো কখনো পারফরম্যান্স আরেকটু বেশি করে হিম্মত জানিয়ে দেয়। এটাই ডেভিল জগতের ধারা।
দেশে এ পর্যন্ত নানা সময়ে এই কিসিমের টপ টেরর, শীর্ষ সন্ত্রাসী, ডেভিলের শিরোমণিদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলেছে। এতে কিছুদিন দম ধরানো গেছে। কিন্তু দমানো যায়নি। কারণ এরা দমে না। পরিস্থিতি দৃষ্টে দম নেয় মাত্র। হাসিনা সরকার ভূপাতিত হওয়ার পর, টেরর বা ডেভিল জগৎ নিয়ে একটি ভিন্নতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একে একে কারামুক্ত হয়ে যায়, তাদের বেশ কয়েকজন। আবার দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করা কয়েকজনও দেশে ফেরে। ফেরার অপেক্ষমাণ রয়েছে কয়েকজন। কারামুক্ত হয়ে বা বিদেশ থেকে ফিরে তারা ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়েছে? না, সে ধরনের কোনো তথ্য নেই। লক্ষণও নেই। বরং কারাগার থেকে বেরিয়ে তাদের অপরাধে জং ধরা হাতে শান দেওয়ার যত খবরাখবর। আধিপত্য নিতে অঘটনও ঘটাচ্ছে। তাদের একের পর এক অঘটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেকটা বিব্রত। এমনিতেই পুলিশের মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে আছে। ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো। সেখানে পুরনো ডেভিলদের উৎপাত। ডেভিল হান্ট অপারেশনে সন্ত্রাসীদের বাসাবাড়ি বা আস্তানায় হানা দিয়ে সুবিধা করতে পারছে না। বাসায় বা আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ওই গোত্রের কাউকে পাচ্ছে না। নমুনা বুঝতে পেরে ডেভিলদের বিশেষ করে কারামুক্ত সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। জনাকয়েক এরইমধ্যে পগারপার হয়েও গেছে। পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজেদুল ইসলাম ইমন এখন মালয়েশিয়ায়। কিলার আব্বাস দুবাইতে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ সম্প্রদায়ের মধ্যে কারামুক্ত হওয়ার একটা রহস্যজনক হিড়িক পড়ে। ঢাকার নামকরা শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজেদুল ইসলাম ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম সোহেল ও হাবিবুর রহমান তাজসহ কয়েকজন জেল থেকে বেরিয়ে আসে। পুলিশের অসহায়ত্বের সুযোগে দেশে ফেরে গোলাম রসুল ওরফে টোকাই সাগরসহ কয়েকজন। ফেরার পাইপলাইনে আছে আরও কয়েকজন। আবার অবস্থা বেগতিক দেখে দেশ ছাড়ার পাইপলাইনেও কয়েকজন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করছে বলে উপলব্ধি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের। কোনো রাখঢাক না রেখে ডিসি সম্মেলনে তা স্পষ্ট করে বলেছেন তিনি। বাস্তবতাটা আসলেই নিদারুণ। এক বেলা না খেয়ে থাকলেও মানুষ স্বস্তি খুঁজতে পারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হলে। সেখানে বড় ব্যত্যয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় অবস্থা। পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করে চলেছেন। খুন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশের ধারণা, কিছু কিছু ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের টপ ডেভিলরা এর পেছনে জড়িত। চাঁদা, টেন্ডার, দখল ইত্যাদির জন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারীদের একটা অংশ প্রাথমিকভাবে চাঁদাবাজির জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র খোঁজে। এ জন্য ব্যবসা বা কাজের মালিক বা নিয়ন্ত্রক এবং তার পরিবারের মুঠোফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর দলনেতা কিংবা তাদের অনুসারীদের কেউ ইন্টারনেট নম্বর বা বিদেশি নম্বর থেকে চাঁদা চেয়ে ফোন করে। পরবর্তী পর্যায়ে ওই ব্যক্তি ও তার পরিবার সম্পর্কে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো উল্লেখ করে হত্যার হুমকি দেয়। এতেও চাঁদা না মিললে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হামলা, গুলি বা ককটেল ফাটানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ভয়ে পুলিশকেও জানাতে চান না।
১৯৯৮ সালে সুইডেন আসলাম, যোশেফ, বিকাশ ও প্রকাশকে ধরতে ৫০ হাজার টাকা করে প্রথম পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার খুনোখুনি ও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বেড়ে গেলে ঢাকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। ঘুরেফিরে কম-বেশি তারাই আবার দৃশ্যপটে। কেন তাদের এভাবে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলো? কারা তাদের ছাড়িয়ে আনার এজেন্ডা নিল? এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না। এমন একটি গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই সাত-আটজন টপ ডেভিলের জামিনে মুক্তি যা-তা বিষয় নয়। তারা তাদের জায়গায় সঠিক। পেশায় আন্তরিক। শুধু জামিনে বের হওয়ারাই নয়, এতদিন আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একাংশও মৌসুম বুঝে নানা অপরাধের জাল বিছিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মহড়া থেকে শুরু করে দখল কিংবা চাঁদা চেয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নতুন খুনেও তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি অপরাধ বিস্তারের কু-বার্তা দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু জামিনে বের হওয়ার পর জোড়া খুনে নাম আসা এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে প্রায় সাড়ে তিন মাসেও গ্রেপ্তার করতে না পারা এবং বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশ কি পালন হলো? পুলিশ কি আসলেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রেখেছে বা রাখতে পারবে? প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে কারাগার থেকে পালানো অপরাধীদের কথাও। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় দেশের কারাগার থেকে পালানো শত-শত আসামি এখনো অধরা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। কাজেই লক্ষণ খারাপ। নজরদারির কথা বলা হলেও, বাস্তবে কি ডেভিলরা নজরদারিতে আছে? প্রশ্ন ওঠে, থাকলে এরা এত অঘটন ঘটায় কীভাবে? বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সামাল দিতে পারছে না পুলিশ। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা? জামিনে বের হওয়া টেররদের বাইরে নতুন গজিয়েছে আরও কতজন! নতুন নতুন গ্যাং তৈরি হয়েছে। কারাগারে বসেই গ্যাং নিয়ন্ত্রণের ম্যাজিক তারা জানে। বিদেশে বসেও স্টিয়ারিং চালাতে পারে। এক সময় নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠার মতো আড়াই ডজনের বেশি শীর্ষ সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে ছিল রাজধানী ঢাকার অপরাধ জগৎ। ‘ক্রসফায়ারে’ পিচ্চি হান্নানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযানের একপর্যায়ে তাদের প্রকাশ্য তৎপরতা কমে আসে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়। বেশির ভাগই বিদেশে পালিয়ে যায়। তবে তাদের নির্দেশে ঢাকায় মানুষ খুন হয়, চাঁদা ওঠে। তারা সিগন্যাল দেয় বিদেশ থেকে। সেই নির্দেশ মতো লাশ পড়ে বা চাঁদা ওঠে বাংলাদেশে।
কেউ আবার পুরনো রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আশায় আছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কারও কারও সখ্য হয়েছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাতে চাচ্ছে কেউ কেউ। তাদের জামিন দেওয়া হলো কেন, কীসের ভিত্তিতে এর হিল্লা হওয়া দরকার। কেউ চাইলেই নিশ্চয়ই তার জামিন হয়ে যায় না। যারা এসব করছে তাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই ভয়ানক। এ সময়ের জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে এইসব শীর্ষ সন্ত্রাসী বগল বাজাতে বাজাতে জামিনে বের হলো, তা কতটুকু যুক্তিসম্মত তা বিশ্লেষণ করা জরুরি। আর এগুলো দেখার ভার যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, সেই উপদেষ্টা কীভাবে এগুলো বরদাস্ত করছেন? এটি আদালতের বিষয়, এখানে সরকারের কিছু করার নেই এ ধরনের কথা কি ন্যায্য?
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনের বিষয়ে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে বড় অপরাধীদের মামলা, জামিন, গ্রেপ্তার ও সামগ্রিক কার্যক্রমের ওপর পুলিশের বিশেষ শাখাসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সব সময় নজরদারি করত। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সহজে বেরিয়ে গেছে। অপরাধী ধরতে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্ট তাদের কতটা রুখতে পারবে সেই জিজ্ঞাসা রয়েছে। এ অভিযানটির উদ্দেশ্য দেশব্যাপী সন্ত্রাসবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। গাজীপুরের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে সংঘটিত এক সন্ত্রাসী হামলায় ছাত্র ও সাধারণ জনগণ আক্রান্ত হন। অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন, যার ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে অবনতি ঘটে। এ থেকে উত্তরণ জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই। আইনশৃঙ্খলার বাজে অবস্থা। অর্থনৈতিক সেক্টরে হাহাকার। তার ওপর সামনে নির্বাচন। ডেভিল হান্ট অভিযান ব্যর্থ হলে অপরাধী চক্রের আস্ফালন বাড়বে। ওরা ভেংচি কাটবে। দেশে-বিদেশে লুকোচুরিতে নয়, সিনা টান করেই আসি-যাই করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চলমান বন্ধ্যাদশা তখন আরও চেপে বসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যকে পেছনে রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া চিন্তাও করা যায় না। এ কঠিন বাস্তবতার শিকার বাংলাদেশ। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। হুমকি-ধমকি বা গতানুগতিক অভিযানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না, তা মুখস্থই বলে দেওয়া যায়।দেশ রুপান্তর
লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ বাংলাভিশন
mostofa71@gmail.com