রাঙ্গামাটিতে আঞ্চলিক পরিষদের ভবন নির্মাণ: পুনর্বাসন ছাড়াই ভূমি উচ্ছেদ, বাঙালিদের প্রতিবাদ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৬৪ দেখা হয়েছে

রাঙ্গামাটি:- পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি শহরে একটি গুরুতর সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসবাসকারী প্রায় চার শতাধিক পরিবারকে পুনর্বাসন ছাড়াই উচ্ছেদের প্রচেষ্টা স্থানীয় বাঙালিদের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। ঘটনাটি বুধবার দুপুরে রাঙ্গামাটির রূপনগর এলাকায় ঘটেছে। স্থানীয় নারী-পুরুষের বিক্ষোভে বাধ্য হয়ে গণপূর্ত বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ লে-আউট কাজ সাময়িকভাবে স্থগিত করে।

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য ১৪.৭৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই জায়গায় গত ১৫-২০ বছর ধরে নিম্ন আয়ের প্রায় চার শতাধিক পরিবার বসবাস করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তারা এই জমি দখল স্বত্বে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে বসবাস করে আসছেন। যদিও তাদের জমির মালিকানার কোনো বৈধ দলিল নেই, তবে তারা নিয়মিত পৌরকর, বিদ্যুৎ বিলসহ সরকারি বিভিন্ন ফি প্রদান করে আসছেন।

গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরা লে-আউট কাজ শুরু করতে গেলে স্থানীয় বাঙালি বাসিন্দারা তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাদের দাবি, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, অন্য কোথাও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা ছাড়া তারা তাদের বসতভিটা ছাড়বেন না।

উপেক্ষিত পুনর্বাসন ও স্থানীয়দের ক্ষোভ: বিক্ষোভরত নারী-পুরুষেরা অভিযোগ করেন যে, সরকার তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না করেই তাদের উচ্ছেদ করতে চাইছে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার নির্দেশে হচ্ছে। এক বিক্ষোভকারী নারী বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় বসবাস করছি। এখানে আমাদের জীবিকা নির্বাহের সমস্ত কিছু। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত না করে সরকার আমাদের উচ্ছেদ করতে পারে না।”

আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, “আমরা এই দেশের নাগরিক। সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও খাদ্য দিচ্ছে। অথচ আমাদের মতো নাগরিকদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। আমরা এই জায়গা ছাড়বো না, যতক্ষণ না আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।”

স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে গণপূর্ত বিভাগের লে-আউট কাজ বন্ধ করতে হয়। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে বিক্ষোভরত বাসিন্দাদের সাথে আলোচনা করেন এবং পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন। তবে এই আশ্বাস কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।

গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তারা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

রাঙ্গামাটি শহরের এই ভূমি সমস্যার পেছনে মূলত সরকারি ভূমি বন্দোবস্ত বন্ধ থাকার বিষয়টি কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বন্দোবস্ত বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষজন বিভিন্নভাবে জমি দখল করে বসবাস শুরু করে। এই জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো বৈধ কাগজপত্রের ব্যবস্থা নেই। ফলে সরকারীভাবে এই জমিগুলো দখলমুক্ত করার প্রচেষ্টা প্রায়ই স্থানীয় বাঙালিদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

সামাজিক ও মানবিক প্রভাব: সরকারি ভবন নির্মাণের জন্য এতগুলো পরিবারকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত মানবিকতার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া তাদের উচ্ছেদ করা সামাজিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এই পরিবারগুলো মূলত নিম্ন আয়ের, যারা দৈনিক শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা গৃহপরিচারিকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

তাদের উচ্ছেদ মানে তাদের জীবনের স্থিতি পুরোপুরি নষ্ট হওয়া। একদিকে মাথা গোঁজার জায়গা হারানো, অন্যদিকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম থেকেও বঞ্চিত হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে তারা কোথায় যাবে এবং কিভাবে জীবন যাপন করবে, তা বড় ধরনের মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে।

বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন: বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন সমস্যার সমাধানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। সরকার যদি এই পরিবারগুলোকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পুনর্বাসন করে, তবে তারা নিজ ইচ্ছায় জায়গা ছাড়তে রাজি হবে। এছাড়া পুনর্বাসনের মাধ্যমে তারা নতুন জায়গায় তাদের জীবনযাত্রা স্থিতিশীল করতে পারবে।

সরকারের উচিত এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। একদিকে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার রক্ষা—উভয় দিকের সমন্বয় করা প্রয়োজন।

রাঙ্গামাটির রূপনগর এলাকার এই ঘটনার পেছনে রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং মানবিক সংকট। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এই সংকট সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদের প্রচেষ্টা স্থানীয়দের মধ্যে শুধু ক্ষোভই নয়, সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি করতে পারে।

উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য জমি ব্যবহারের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। পুনর্বাসন, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, এবং পুনর্বাসিত জায়গায় জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। সরকারের দায়িত্ব উপজাতিদের পাশাপাশি বাঙালি নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নত করা।

এটি নিশ্চিত করা গেলে রাঙ্গামাটির এই সংকট শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্পের সফল উদাহরণ হয়ে উঠবে না, বরং স্থানীয় মানুষের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীলতারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions