ডেস্ক রির্পোট:- আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিলেও তাদের রেখে যাওয়া প্রকল্পগুলো এখন তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামকাওয়াস্তে সমীক্ষা দেখিয়ে নেয়া প্রকল্পগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও কাজ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কক্সবাজার জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদী বরাবর পোল্ডারগুলোর (৬৭/এ, ৬৭, ৬৭/বি এবং ৬৮) পুনর্বাসন প্রকল্প সেই সব প্রকল্পগুলোর একটি। তিন বছরের প্রকল্পটি গত আট বছরে মাত্র ৪৩ শতাংশ কাজ করতেই হাঁপিয়ে উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি)। এই সময়ে খরচ বেড়েছে মোট ১৯৫ শতাংশ বা ২৫৭৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। দশ বছরেও প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশন। দফায় দফায় নকশা পরিবর্তনে অসন্তোষ প্রকাশ করা প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে কমিশন বলছে, কোথাও কোথাও ইটের মান ও আকৃতি কোনোটিই যথাযথ নয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য থেকে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পূর্ব দিকে মিয়ানমার অবস্থিত। টেকনাফ-উখিয়া ও মিয়ানমার এর মাঝ বরাবর নাফ নদীটি প্রবাহিত। নাফ নদীর ডান তীর বরাবর বাপাউবো কর্তৃক ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নির্মিত পোল্ডার নং-৬৭/এ, পোল্ডার নং ৬৭, পোল্ডার নং ৬৭/বি ও পোল্ডার নং ৬৮ এর আওতায় ৪৭.৬০ কিমি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং ৪৬টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো রয়েছে। এটির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকল্প এলাকায় নাফ নদীর লবণাক্ত পানির প্রবেশ রোধ করা। একই সাথে বন্যা ও উচ্চ জোয়ারের হাত থেকে প্রকল্প এলাকায় শস্য ও জান-মাল রক্ষা করা। পানি নিষ্কাশন অবকাঠামোসমূহ বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনে সহায়তা করে। ১৯৯১, ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১০ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অতিবৃষ্টির প্রভাবে উল্লিখিত ৪৭.৬০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও পানি নিষ্কাশন অবকাঠামোগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উক্ত ৪৭.৬০ কিমি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বরাবর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং সীমান্ত অপরাধ প্রতিহত করার জন্য টহল এলাকা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের পানির ঘন ঘন উপচেপড়া এড়ানোর জন্য বাঁধের উচ্চতা বাড়িয়ে (পূর্বে বাঁধের উচ্চতা ছিল ২.২৫-৩.০০ মিটার) ৫.৫০ থেকে ৬.৫০ মিটার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির টহলের ভারী যানবাহন চলাচল সহজ করার জন্য বাঁধের প্রশস্ততা আগের সর্বোচ্চ তিন মিটার থেকে বাড়িয়ে ৭.৩০ মিটার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে অনুযায়ী পানির কাঠামো, স্লুইস গেট ও রেগুলেটরের প্রশস্ততা বৃদ্ধিসহ সংখ্যা যৌক্তিকরণ করা প্রয়োজন। ২০১৫ সালে বাপাউবোর গঠিত কারিগরি কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।
প্রকল্পের খরচ ও ব্যয় বৃদ্ধি
এ দিকে সরকারি অর্থায়নে মোট ১৪১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। পরে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া অক্টোবর ২০১৯ থেকে জুন ২০২১ মেয়াদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। আবার এক বছর করে দুইবার অর্থাৎ জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে জুন ২০২৫ মেয়াদে চার বছর বাড়িয়ে পৌনে আট বছর করা হয়, যা ২০২২ সালের ২ আগস্ট একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। এখন মেয়াদ আরো দুই বছর ও খরচ মোট ২৭৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে জুন ২০২৭ মেয়াদে খরচ ৪১৮ কোটি আট লাখ টাকা প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি ও পানি সম্পদ বিভাগ বলছে, প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর জন্য প্রস্তাবিত আরডিপিপির ব্যয় মূল প্রকল্প ব্যয় থেকে ২৭৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ১৯৫ শতাংশ বেশি। আর প্রথম সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় থেকে ৪৯.৪২ কোটি টাকা ১৩.৪০ শতাংশ বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: আবু রায়হান মূল্যায়ন কমিটিকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং জাতীয় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় কারিগরি টিমের পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর নকশা বেশি অভিঘাত সহনশীল করার জন্য একাধিকবার পরিবর্তন করতে হয়েছে।
১২ রেগুলেটর বাদ প্রসঙ্গ
পিইসি সূত্র বলছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক পিইসিকে জানান যে, প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রথম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ৩৩টি রেগুলেটরের মধ্যে ৩২টি রেগুলেটর পুনঃনির্মাণ করা জরুরি। বাঁধের অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তনের কারণে একটি রেগুলেটর নির্মাণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রকল্পের ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি রেগুলেটর পরে নির্মাণের জন্য চলমান এই প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
সঠিকভাবে সমীক্ষা হয় না
পর্যালোচনায় কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো: ছায়েদুজ্জামান বিশ্লেষণ তুলে ধরে পিইসি সভাকে জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বেশির ভাগ প্রকল্প পূর্ণাঙ্গ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই খসড়া নকশার ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। পরে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বিভিন্ন অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয়। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি সময় ও অর্থ বেশি লাগে। এতে প্রকল্পের কাক্সিক্ষত সুফল যথাসময়ে পাওয়া যায় না।
প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন
সেচ অণুবিভাগের কর্মকর্তাদের পরিদর্শন টিম বলছে, এইচবিবি কাজের মান যাচাইকালে দেখা যায় যে, কোথাও কোথাও ইটের মান ও আকৃতি যথাযথ নয়। অনেক জায়গায় রেইন কাট পরিলক্ষিত হয়েছে। কোথাও ইটের সোলিংয়ের পাশে পর্যাপ্ত সোল্ডার রাখা হয়নি। সুতরাং যে সব সাইটে ইটের মান ও আকৃতি যথাযথ নয়, সে সব সাইটে ইট পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগামীতে এই ধরনের অনিয়মের বিষয়ে ঠিকাদারদের সতর্ক থাকার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে। যেসব জায়গায় রেইন কাট দেখা গেছে এবং ইটের সোলিংয়ের পাশে পর্যাপ্ত সোল্ডার রাখা হয়নি, সেসব স্থানে ইটের সোলিংয়ের পাশে পর্যাপ্ত মাটি ভরাটের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. মো: নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া মূল্যায়ন সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তিন বছরের জন্য অনুমোদিত প্রকল্প আট বছরে শেষ হয়নি। প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৪৩ শতাংশ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ছাড়াও বারবার প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন। তিনি বেশি টেকসইভাবে নতুন ডিজাইন অনুসারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ভারী টহলযান চলাচলের উপযোগী করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য বলেন।
প্রকল্পের ব্যাপারে যা বললেন পিডি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: আবু রায়হানের সাথে প্রকল্পের ব্যাপারে গতকাল রাতে তার মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিইসি সভায় প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার পর কিছু পরামর্শ দিয়ে ডিপিপিকে আবার সংশোধন করে পাঠাতে বলেছেন। প্রকল্প সম্পর্কে ওনারা সব কিছুই জানেন। ফলে প্রকল্পে কী করতে হবে, কী করা উচিত, কী করলে ভালো হয়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।
এতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূল প্রকল্প অনুমোদনের পর দুইটা সিজন পার হয়ে গেছে। সীমান্ত এলাকার প্রকল্প। এখানে সমস্যা, কাজ করাও কঠিন। বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে কাজ করা যায় না। তিনি বলেন, আমাদের এখানে স্ট্রাকচার ছিল ৩৩টি। একটা স্ট্রাকচার করতে গেলে বোরিং করতে হয়। মোট ২৪০টি বোরিং করতে হবে। এটাতে অনেক খরচ। সেই টাকারও সংস্থান ছিল না। আর এখানকার মাটির অবস্থাও ভালো না। এ কারণে নকশাও পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি বলে জানান আবু রায়হান। তিনি বলেন, ওটা ছাড়াই প্রকল্প করা হয়েছে। যখন এটা ২০১৭ সালে শুরু হয়, তখন যে বিধিবিধান ছিল, সেটা অনুযায়ীই প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এখন যে বিধিবিধান আছে সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।নয়া দিগন্ত