এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার চলে ২৩ জেলায়

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ২০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলা। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে প্রায় সবক্ষেত্রেই। তবে বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জন্য নির্মিত তিনতলা একটি পুরোনো ভবনে চলছে সব আদালতের বিচারকাজ। অবকাঠামোগত সংকটের কারণে এখানে বিচারকরা এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ করেন। এ ছাড়া মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারকরা বসছেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পাশে করা টিনশেড ভবনে। ফলে অনেক সময় বিচারকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরাও।

শুধু গাজীপুরেই নয়, জমি অধিগ্রহণের পর ১০ বছর পার হলেও শরীয়তপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। ফলে ভবন সংকটের কারণে এজলাস বসাতে না পারায় বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ জেলায়ও এজলাস ভাগাভাগি করে পালাক্রমে বিচারকাজ করে থাকেন বিচারকরা। একইভাবে সারা দেশের ২৩ জেলায় এখনো ভবন সংকট রয়েছে। সব জেলায় এভাবে এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার করছেন বিচারকরা। এতে করে মামলা নিষ্পত্তিতে প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরাও। এ সংকট নিরসনে ২০০৮ সালে উদ্যোগ নেওয়া হলেও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি এসব জেলায়।

নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কারণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিচারিক আদালত জেলা জজ আদালতে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফৌজদারি বিচারকাজ পরিচালনার জন্য আলাদা বিচারক এবং এজলাসের প্রয়োজন হয়; কিন্তু জেলা জজ আদালত ভবনে জেলা জজশিপের বিচারকার্য পরিচালনা করার প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অবকাঠামো ছিল না। ফলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন তৈরি না হওয়ায় শুরু থেকে ফৌজদারি বিচারকাজে নানা সমস্যা তৈরি হয়।

বিষয়টি লক্ষ করে ২০০৮ সালে প্রতিটি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরপর ধীর গতিতে চলে এই প্রকল্পের কাজ। প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর দেড় যুগ পার হলেও এখনো ২৩ জেলায় এই ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ভবন সংকটে জেলা জজ আদালতের বারান্দাকে এজলাস বানিয়েও অনেক জায়গায় বিচারকাজ চালাতে হচ্ছে। একই এজলাসে দিনে দুই বা তিনজন বিচারক ধারাবাহিকভাবে কাজ করেন। একই খাস কামরায় দু-তিনজন বিচারক বসায় গোপনীয়তা রক্ষা করা ও মামলায় রায় ঘোষণা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। নিজস্ব ভবন না থাকায় আদালতের অন্যান্য কর্মচারীও গাদাগাদি করে বসে কাজ করছেন। অন্যদিকে নথি সংরক্ষণ করা ও মামলার আলামত, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে। অনেক জায়গায় জেলা প্রশাসন ভবনেও আদালত বসছে।

গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকরা বিচারকাজ করেন। টঙ্গীর অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালত একটি এজলাসে বসেন দুপুর ১টার সময়। ওই একই এজলাসে কাপাসিয়ার কোর্ট বসে সকালে। কাপাসিয়া কোর্টের বিচারক সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিচারকাজ করেন। এতে করে বিচারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এখানে চিফ জুডিশিয়াল ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারকদের জন্য টিনশেড ভবন আছে। সেখানেই বিচার চলছে। আবার এসব কোর্টের স্টাফরাও গাদাগাদি করে বসছেন। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করা উচিত।’

জানা গেছে, ৬৪ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। এরপর ২০০৮ সালে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত মূল অনুমোদিত প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৭১৩ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এরপর প্রথম সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭০ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্পে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ২৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা। বিশেষ সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে হয় ২ হাজার ৪৬৪ কোটি ৬০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। তবে তৃতীয় সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬০ কোটি ৩৪ লাখ ২৬ হাজার টাকা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে জুন ২০১৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের সময়সীমা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে জুন ২০২৩ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর গত ১৬ বছরে ৪১টি জেলায় এই ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। বাকি জেলাগুলোয় ভবন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের কাজ মাত্র শেষ হয়েছে। আর এসব ধীর গতির পেছনে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহাকে দায়ী করছেন অনেকেই। তাদের গাফিলতির কারণে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ২৩টি জেলার মধ্যে ২২টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের পর প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তাতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এটি সংশোধন করে ব্যয় কমতে পারে বলে জানা গেছে।

জানতে চাওয়া হলে আইন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা হয়েছে। এতে ভবনের নকশায় সমস্যা ধরা পড়ে। পরে নকশা সংশোধনের জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এখন নকশা সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে। এরপর এটি গণপূর্তে পাঠানো হবে ব্যয় নির্ধারণের জন্য। এরপর এটি পরিকল্পনা কমিশনে উঠবে ফাইনাল অনুমোদনের জন্য। এ কাজ শেষ হতে মার্চ-এপ্রিল লেগে যেতে পারে। প্রকল্প অনুমোদনের পর কাজ শুরু হলে ভবন নির্মাণে লাগবে আরও তিন থেকে চার বছর।’

এদিকে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ না হওয়ায় আবাসন সংকটের কারণে বিপাকে বিচারপ্রার্থী, বিচারক ও আদালতের স্টাফরা। জানতে চাওয়া হলে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘২৩টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন দীর্ঘদিনেও হয়নি। এতে করে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। দুর্ভোগে পড়ছেন বিচারক, আদালতের স্টাফ ও বিচারপ্রার্থীরা। এসব জেলায় ভবনগুলো দ্রুত নির্মাণ প্রয়োজন। দ্রুত ভবনগুলো হলে বিচার বিভাগ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থও রক্ষা হবে বলে মনে করি।’

শরীয়তপুর জেলা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে নারী ও শিশু আদালত বসছে ভাঙাচোরা টিনশেড ভবনে। এমনভাবে ছয়জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট টিনশেড ভবনের এজলাস শেয়ারিং করে কাজ করছেন। এতে নথিপত্র খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি বিচারের কাজে মারাত্মকভাবে বিঘ্ন ঘটছে। নতুন একটি ভবনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জমি অধিগ্রহণ হলেও ভবন এখনো কেন হচ্ছে না, তা আমাদের জানা নেই। তবে সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের কাজ সঠিক ও সুন্দরভাবে করার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ভবন নির্মাণের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

যেসব জেলায় এখনো ভবন হয়নি: গাজীপুর, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, চাঁদপুর, নওগাঁ, নাটোর, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, মেহেরপুর, বরগুনা, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, শেরপুর ও নেত্রকোনা।কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions