ডেস্ক রিপোট:- পাল্টে যাচ্ছে দেশের নাম। থাকছে না ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। বিদ্যমান ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর স্থলে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ গঠন এবং বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সাম্য, বহুত্ববাদসহ পাঁচটি মূলনীতি করার প্রস্তাব করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে। এছাড়া মূলনীতিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করা হয়েছে, যার মেয়াদ হবে চার বছর করে। সংসদের মতো রাষ্ট্রপতির মেয়াদও হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। জীবদ্দশায় দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ ও স্থানীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠিত হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, অর্থপাচারসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কোনো দলের সদস্য হতে না পারা, আইসিটি আইনে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় নির্বাচন হবে। এমনসব সুপারিশ এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত চারটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
বুধবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরে বিকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পক্ষে আইন, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান। এছাড়া সংস্কার কমিশনের প্রধানরাও পৃথক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরেন। পাশাপাশি তারা ওয়েবসাইটেও সুপারিশমালা আপলোড করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ সমন্বয় করার জন্য প্রতিবেদন জমা দেওয়া চারটি কমিশনসহ মোট ছয়টি কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিশনগুলো বসে প্রাধান্যগুলো ঠিক করবে। এরপর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হবে। তবে সংস্কার কমিশনগুলো তাদের কাজ আগেভাগে শেষ করতে পারলে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে সংলাপ শুরুর সম্ভাবনা আছে বলে জানানো হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। এগুলো হলো : স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ ও মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
কমিশন তার সুপারিশে জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনাসহ বিধিবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনায় পরিবর্তন এনে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ পরিবর্তে ‘জনযুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ যুদ্ধের চেতনা এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার আদর্শে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। জনগণের সম্মতি নিয়ে এই সংবিধান ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
নাগরিকতন্ত্রের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’, ‘Peoples Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো বিদ্যমানের মতো রাখার কথা বলা হয়েছে।
ভাষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র পাশাপাশি নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সব ভাষা এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশি’ প্রতিস্থাপিত করার সুপারিশ এসেছে। বিদায়ী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যুক্ত হওয়া সংবিধানবিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক ও ৭খ বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে।
সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এই সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিদ্যমান অধিকারের অনুচ্ছেদগুলোর সংস্কার- যেমন বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের সীমিত তালিকা বর্ধিতকরণ, জীবনের অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নিবর্তনমূলক আটক-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করছে; একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (National Assembly) ও একটি উচ্চকক্ষ (Senate-সিনেট)। দুটি কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।
এর মধ্যে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। এর আসনসংখ্যা হবে ৪০০। এর মধ্যে ৩০০ জন একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। বাকি ১০০ জন নারী সদস্য হবেন। এ ক্ষেত্রে দেশকে ১০০টি নির্বাচনি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদ সদস্য নির্বাচনের বয়স বিদ্যমান ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংসদে দুজন স্পিকার থাকবেন, যার একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন।
কোনো নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলের প্রধান একক ব্যক্তি হতে পারবেন না। অর্থবিল ছাড়া সব ক্ষেতে নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। সবগুলো স্থায়ী কমিটির সভাপতি হবেন বিরোধীদলীয় সদস্যরা।
উচ্চকক্ষ ১০৫ জন সদস্য থাকবেন, যার মধ্যে ১০০ জন সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাকি পাঁচটি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবেন।
রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কমপক্ষে সংসদ নির্বাচনে এক শতাংশ ভোট পেতে হবে।
সংবিধানের সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
আন্তর্জাতিক চুক্তির আগে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ প্রস্তাব পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে।
তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতসহ ভারসাম্য রক্ষায় একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং তৃতীয় প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনোনীত একজন সদস্য।
নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য, প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’, ‘সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’-এর পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন।
রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও হবে চার বছর। কোনো ক্রমেই কেউ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। এ সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্টস কমিশন) গঠন করা হবে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। ‘অধস্তন আদালত’-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে, যা একজন প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনার ও চারজন কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে। সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হবে বলে সুপারিশ করা হয়।
সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনগুলোর মেয়াদ হবে ৪ বছর।
জরুরি অবস্থার বিধানাবলি : কেবল এনসিসির সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ১৫০টি সুপারিশ দিয়েছে। তাদের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সংবিধান সংশোধন
করে একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করে তার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল ও পুনর্নির্বাচনসহ কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো, কমিশন সচিব নিয়োগ কমিশনের ওপর ন্যস্তকরণ, জাতীয় নির্বাচনের পর গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের আগে, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া, ফলাফলে সংক্ষুব্ধ হলে গেজেট প্রকাশের আগে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টি, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত, ইসি কর্তৃক ‘ভোটার প্রার্থী মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, নির্বাচনী ও পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষা দেওয়া, আউয়াল কমিশন যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিয়েছে, যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা। এ ছাড়া ইসি সংস্কার কমিশন, কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের বা সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপনের বিধান করা; কমিশনারদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরাহা, রিটার্নিং কর্মকর্তা/সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগে ইসির কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার, নির্বাচন কমিশনের ব্যয় পুনরায় নির্ধারণ, নির্বাচন কমিশনের জনবল নিয়োগে পৃথক সার্ভিস কমিশন গঠন, ঋণ খেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা, ফেরারি আসামি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শুরু থেকেই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করা, আইসিটি আইনে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে) শান্তিপ্রাপ্তদের সংসদ নির্বাচনে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শুরু থেকেই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করা, গুরুতর মানবাধিকার (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, সাংবাদিকদের/মানবাধিকারকর্মীর ওপর হামলা ইত্যাদি) এবং গুরুতর দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগে গুম কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত হলে তাদের একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য করা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদত্যাগ না করে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করা; তরুণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শতকরা ১০ ভাগ মনোনয়নের সুযোগ তৈরির বিধান করা, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বা নির্বাচিত হলে তা বাতিল করা, একাধিক আসনে কোনো ব্যক্তির প্রার্থীর হওয়ার বিধান বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ৫ বছরের আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার বিধান করা, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান বাতিল করা, প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা ও কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যদের প্রত্যাহারের (রিকল) বিধান করার সুপারিশ করেছে। সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি, আবাসিক প্লট, সব ধরনের প্রটোকল ও ভাতা পর্যালোচনা ও সংশোধন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং এ নির্বাচন নির্দলীয় করার জন্য আইন সংশোধন করার সুপারিশ করা হয়েছে। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের বিধান করা; এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নির্বাচিত হলে শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগের বিধান করা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে জাতীয় বাজেটের ৩০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার বিধান করার সপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত শিথিল ও ৫ বছর পর পর দল নিবন্ধন নবায়ন বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রবাসী পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা; অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থা, প্রবাসীদের ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করে কমিশন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে বলে কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সরকার চাইলে ২০১৩ ও ২০২৪ সালের ভোটের বিষয়টি তদন্ত করতে পারে বলে তিনি জানান।
নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম বা যেকোনো নামেই হোক না কেন, না থাকার বিধান করা; দলের কোনো বিদেশি শাখা না থাকা; সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য তিন বছরের সদস্য পদ থাকা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করছে ইসি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণে ভবিষ্যতে একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা; এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের বিধান বাতিল করা; নাগরিকের তথ্য ফাঁসের ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শান্তির ব্যবস্থা করা; ভবিষ্যতে ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী শিশুদের জন্য পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম গ্রহণ; ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংস্থা’ নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠনের সুপারিশ এসেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
ad
দুদক সংস্কার কমিশন
৪৭ দফা সুপারিশসহ, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন। দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা বিবেচনায় যে ধরনের পেশাগত বৈচিত্র্য থাকা দরকার, সেটি নিশ্চিত করতে একজন নারীসহ পাঁচজন দুদক কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মেয়াদ হবে চার বছর। বুধবার দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান এই কথা বলেন।
সংস্কার কমিশন বলছে, দেশে জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কোনো কৌশল নেই। দুর্নীতি দমন শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। যেমন- সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন কমিশন, ব্যবসা খাত ও রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী ভূমিকা থাকতে হবে। যে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণ করা থাকবে, যার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে— সেটি নিয়মিতভাবে নজরদারি করতে হবে। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আয়ব্যয় নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। হলফনামার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যদি হলফনামায় পর্যাপ্ত তথ্য না থাকে, তথ্য গোপন করা হয় ও বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ থাকে, তবে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দেশ-বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ‘কমন রিপোর্টটি প্র্যাকটিস’–এর আওতায় আনার কথা বলেছে কমিশন। এর মাধ্যমে বিএফআইইউসহ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব লেনদেনের তথ্য জানতে পারবে। এটি বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতে হবে। ১২২টি দেশ ইতোমধ্যে এই প্র্যাকটিসের অধীন এসেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে বাংলাদেশ এখনো হয়নি।
সংস্কার কমিশন বলছে, দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। ভালো কাজের যেমন প্রশংসা থাকবে, তেমন কাজ করতে না পারলে জবাবদিহি করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যিনি রয়েছেন, তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই কমিটির প্রধান করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সদস্য হবেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), সংসদ নেতার মনোনীত একজন, প্রধান বিরোধীদল থেকে মনোনীত একজন। এ ছাড়া একজন সরাসরি প্রধান বিচারপতি থেকে নিযুক্ত হবেন, যার দুর্নীতিবিরোধী কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুদককে আমলাতন্ত্র মুক্ত করতে সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক— পদগুলোতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যারা দুদকের কাজের জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করবেন, তারা এসব পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ ও প্রশিক্ষণ একাডেমি করা, ৫৪–এর ৩ ধারা বাতিল এবং বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার
জুলাই-আগস্ট ঘটনায় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে সুপারিশে। এ ছাড়া এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার না করা, ভুয়া/গায়েবি মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা; দোষী সাব্যস্ত না হলে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন না করা এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে অথবা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে জরুরি কল সার্ভিস চালু; অভিযানের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ ভেস্ট/পোশাক পরিধান; রাতের বেলায় ঘর তল্লাশিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট/স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি/স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ; আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা; পুলিশ কমিশন গঠন, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা, তদন্ত ও পুলিশ ভেরিফিকেশন, চাকরি প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রহিত করাসহ ভেরিফিকেশন ১ মাসের মধ্যে শেষ করা; পুলিশের কাজকর্মে ইচ্ছাকৃত ব্যত্যয় বা পেশাদারি দুর্নীতি রোধে স্বল্পমেয়াদি একটি কার্যক্রম হিসেবে ‘ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি’ গঠন করা যায়। প্রতিটি থানা/উপজেলায় একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গড়ে তোলা যায়, যারা স্থানীয় পর্যায়ে ‘ওভারসাইট বডি’ হিসেবে কাজ করবে এবং দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। বর্তমানে প্রচলিত কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারণ করে এটিকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রস্তাব করা হলো, যা পুলিশের জবাবদিহি বৃদ্ধি করবে এবং পুলিশের কাজে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবে।আমারদেশ