ডেস্ক রির্পোট:- লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান বিজয়ের ৫৩ বছরপূর্তি আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীমুক্ত হয় প্রিয় মাতৃভূমি। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সীমাহীন বৈষম্য ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে নিজেদের মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি আকাক্সক্ষী বাঙালি। পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ দল-মত ভুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মরণপণ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির শৌর্যবীর্যের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা, নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ যে বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তা থেকে সাধারণ মানুষের আজও মুক্তি মেলেনি। এই সময়ে আমাদের জাতিগত সমৃদ্ধি, নিজস্ব সক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সংহত হয়েছে। কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হয়নি। মানুষের মধ্যে বিভেদ, বৈরিতা, বঞ্চনা কমেনি। সমাজের সর্বস্তরে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে।
অভিযোগ ওঠে, মহান স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ দেশের মানবাধিকার। সর্বশেষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে গণতন্ত্র ধ্বংস, ভোটাধিকার উপেক্ষা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার বলতে কিছুই ছিল না, দুর্নীতির শিখরে ওঠে বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল। মানুষকে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি, ভোট ছাড়াই নেতা নির্বাচিত হয়ে গেছেন ক্ষমতাসীনরা। এমনকি নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে আটকে রেখে প্রার্থীবিহীন-প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশে। বিরুদ্ধ মত উপেক্ষিত ও ক্ষেত্রবিশেষে নিপীড়িত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি রক্তক্ষয়ী সফল মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বিগত ৫২ বছরে এ দেশের মানুষ বারবার বঞ্চিত হয়েছে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থেকে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী যথারীতি সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু শাসনব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ কারণেই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে গুণগত কোনো পার্র্থক্য দেখেনি জনগণ। নির্বাচনে জনগণ যখনই সুযোগ পেয়েছে সরকার বদল করেছে। কিন্তু দুঃশাসন, চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট, বিরুদ্ধ মত দমনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। জনগণ বারবার হতাশ হয়েছে। এভাবেই চলছিল অনেক বছর। জনগণের হাতে পাঁচ বছর পরপর সরকার বদলানোর ভোটের ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার পরও এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিএনপি প্রথমে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও পরে ২০০৭ সালে এবং আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে নির্বাচনের প্রহসন করে। মানুষের ভোটের ক্ষমতা ছিনতাই হয়ে যায়। মানুষ গোপনে ও প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারই প্রতিফলন চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। গণ অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং দেশত্যাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুশাসন ও ন্যায়বিচার গণতন্ত্রেরই অনুষঙ্গী। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গণতন্ত্র হরণ করেছে, সেই সঙ্গে সুশাসনও। দুঃশাসনে বিষিয়ে তুলেছে মানুষের মন। এশিয়ার ক্ষুদ্র জেলেপল্লি থেকে বিকশিত সিঙ্গাপুর তার জনগণের মন জয় করেছে সুশাসন দিয়ে। আমাদের কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন হয় তারা। আমাদের চেয়ে মাত্র ছয় বছর আগে, ১৯৬৫ সালে। সেই সিঙ্গাপুর আমাদের চেয়ে শত গুণ এগিয়ে গেছে। কিন্তু দুঃশাসন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের কারণে আমরা পেছনেই পড়ে আছি। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে জাতির ভবিষ্যৎকে কবরের অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছি।
এমন অসংখ্য অসংগতির জের ধরে এ বছর জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নতুন আবির্ভাবের পথরেখা উন্মোচিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে এসেছে। বলা হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কাঠামোর বিদ্যমান অব্যবস্থা-অসংগতি দূর করার সুযোগ এসেছে। এর আগে বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ২০২৩ সালের ১১ জুলাই ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচি নিয়ে দলটির নেতারা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে শুরু করেছেন। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও রাষ্ট্রকাঠামোয় কার্যকর কোনো পরিবর্তন না আনায় সংস্কারের দাবিটি অনেক আগে থেকেই ছিল। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেটি এখন জোরালো হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলোর চলতি ডিসেম্বর মাস থেকে পর্যায়ক্রমে তাদের সুপারিশ পেশ করার কথা।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও রাজনৈতিক ও সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও গণমানুষের প্রত্যাশার কারণে বিদ্যমান কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু কার্যকর সংস্কারের জন্য ইতিপূর্বে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সংহতির অভাবে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা সেই সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের কারণে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত হয়নি। মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত থেকে গেছে অর্ধশতাব্দী ধরে।
জাতির কাঁধে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা আওয়ামী দুঃশাসন উৎপাটিত হওয়ার পর দেশবাসীর সামনে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট পূরণের মধ্য দিয়েই জাতির সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সেই কমিটমেন্টের দোদুল্যমানতা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের সময়কাল সীমিত। তারা রাজনৈতিক কাজে নিয়োজিত হয়েছেন কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই। শত শত এজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে চাইছেন তারা। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রইল। এ সরকারের কোনো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা নেই বলেই মনে করে দেশের মানুষ। মানুষ চায় রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের মতামত ও সহযোগিতা নেবে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার সব চেষ্টা নিবেদিত করবে। যার একমাত্র লক্ষ্য দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণ। তাদের পক্ষেই নির্মোহভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি শুরু করে যাওয়া সম্ভব, যা দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার।