নন্দন দেবনাথ, রাঙ্গামাটি:- আজ রাত পোহালেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পুর্তি করবে। পাহাড়ের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার পাহড়ের ২ যুগেরও বেশী সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস এর সাথে চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। কিন্তু সেই দিনই এই চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায় দিয়ে লংমার্চ করে বিএনপি জামায়াত সহ বিভিন্ন বাঙ্গালী সংগঠন। দীর্ঘ ২ যুগের মৃত্যুর মিছিল থামাতে চুক্তি করা হলেও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হানাহানিতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩২৭ জনের মতো। এখানে অপহরণ, চাঁদাবাজী ও বন্দুকযুদ্ধের কোন হিসাব নেই। প্রতিনিয়ত আধিপত্যকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক গ্রুপ গুলোর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ লেগেই আছে। এখন দেখার বিষয় অন্তবর্তীকালীণ সরকার পাহাড়ের সংঘাত বন্ধে কি উদ্যোগ নিচ্ছে এবং পার্বত্য চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যা দেয়া বিএনপি জামায়াত কি উদ্যোগ থাকবে এই চুক্তি নিয়ে।
১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ঘটা করে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দানের মাধ্যমে পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র তুলে নেয়ার যে মিশন নিয়েছিল তাতে সফল হতে পারেনি। এর আগেই প্রসিত খীসার একটি গ্রুপ এই চুক্তিকে না মেনে কালো পাতাকা উত্তোলন করেন। তৈরী করা হয় ইউপিডিএফ নামে আরো একটি আঞ্চলিক সংগঠন। শান্তি চুক্তির পাওয়া না পাওয়া নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের দীর্ঘ সুত্রিতার কারণে দীর্ঘ কালক্রমের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে জন্ম নেয় পাহাড়ের আরো একাধিক সংগঠন। এই সংগঠন গুলোর হচ্ছে জেএসএস সংস্কার, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ, মগ লিবারেল পার্টি এবং সর্বশেষ জন্ম নেয় কেএনএফ নামে আরেকটি শক্তিশালী সংগঠন।
পাহাড়ে দীর্ঘ এই সংঘাত বন্ধের চেষ্টা ও বিশ^াস অবিশ^াসের মধ্যে দিয়ে প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে পাহাড়ে শান্তি ফেরার কথা ছিল যেখানে ২৭ বছর আগে, সেখানে এখনো সংঘাত থামেনি। পাহাড়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের হামলায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। শান্তি চুক্তির আগে পর্যন্ত পাহাড়ের মৃত্যুর মিছিল ছিল দীর্ঘ লাইন। সেই মিছিল থামাতে চুক্তি করা হলেও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হানাহানিতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩২৭ জনের মতো। এখানে অপহরণ, চাঁদাবাজী ও বন্দুকযুদ্ধের কোন হিসাব নেই। প্রতিনিয়ত আধিপত্যকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক গ্রুপ গুলোর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ লেগেই আছে।
সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি। বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৯১৩ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩২৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন।
এদিকে পাহাড়ের অনেকেই মনে করছে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তাবায়ন এখন আরো বাধা গ্রস্থ হবে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পার্বত্য শান্তি চুক্তি নাকি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়বে। দীর্ঘ বছরে পাহাড়ী বাঙ্গালী সংঘাত বন্ধ থাকলেও ৫ আগষ্টের পর থেকে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ী বাঙ্গালীদের মাঝে আত্ম বিশ^াস কমে গেছে। পাহাড়ের পাহাড়ী বাঙ্গালী সংঘাত, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, লুটপাট সহ বিভিন্ন কারণে এইখানে বিশ^াস খুবই ঠুংকো হয়ে গেছে। সংঘাত বন্ধে পাহাড়ের মানুষের আত্ম বিশ^াস বাড়াতে একটি শাক্তিশালী উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন পাহাড়ের মানুষ।
রাঙ্গামাটি জাসাস সভাপতি মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, পাহাড়ে শান্তিু চুক্তির ফলে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত কমলেও আমাদের মাঝে যে আস্তার অভাব রয়েছে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা পাহাড় বাঙ্গালী বুঝি নাম আমরা সবাই বাংলাদেশী আমরা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ, আমরা রাঙ্গামাটির মানুষ। আমাদের সকলকে এক থাকতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সম্প্রীতির কথা যদি বলি উচ্চ মহল ও প্রশাসন থেকে দেখি সম্প্রীতির র্যালী করে। আসলে এ গুলো কিছুই হবে না এই সম্প্রীতি অন্তর থেকে ধারণ করতে হবে। মন থেকে এগিয়ে আসলে এই চুক্তিটা বাস্তবায়ন সম্ভব। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে আমাদের লাভ হবে লস হবে না। আমরা সকলেই বাংলাদেশী আমরা সকলে মিলে মিশে থাকতে চাই।
রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক বলেন, তৎকালীণ সরকার ২ দশকের সংঘাত হানাহানি শেষ করতে একটি চুক্তি করেছিল। চুক্তিটি নিয়ে সমালোচনা হোক আর যাই হোক এ কথা নিসন্দেহে বলতে পারি চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তি ফিরে এসেছে। শান্তি আসার পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নও হয়েছে। চুক্তিটি পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ীদের মনে ক্ষোভ আছে। তাই এই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীতে মিছিল সমাবেশ করছে। আমার মতে চুক্তির কোন জায়গায় অসংগতি থাকে তা পুনঃ মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা দরকার। এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ সদস্য মোঃ হাবিব আজম বলেন, পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে চুক্তি করা হযেছে সেই শান্তি আমরা পায়নি। এখনো পাহাড়ী বাঙ্গালীদের মাঝে আস্থা বিশ^াসের যে সংকট তা এখনো রয়ে গেছে। সংবিধান বার বার পবির্তন করা হয়েছে। এই চুক্তিও পরিবর্তন করা সম্ভব। পাহাড়ী বাঙ্গালী অন্যান্য যে ছোট ছোট নৃ গোষ্ঠী রয়েছে বাঙ্গালী সহ সকল সম্প্রদায়ের সাথে আলোচনা করে এই চুক্তিটি পুর্ন মূল্যায়ন করা জরুরী। কেন এই পাহাড়ে শান্তি আসছে না। সকলে যাতে সমান অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হয়, কেউ যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় সে জন্য প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করে এই চুক্তিটি পূর্ণ মূল্যায়ন করা জরুরী। বর্তমান বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলে দেশে স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে এখন একটি টেবিলে আসা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশ্লেষক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়া বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা অনেকে জায়গায় দেন দরবার করেছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। চুক্তি বাস্তাবয়নকারী সংস্থা জেএসএস ও সরকারের মধ্যে অনেক দরকশাকসি হয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তিতে এখন ড্রিফ ফ্রিজে তাকে বের করতে হবে। অন্তবর্তীকালীণ সরকারের কাছে অনেক আশা প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে। প্রধান উপদেষ্ঠা শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। আমরা আশা করছি তিনি চুক্তি মৌলিক ধারা গুলো বাস্তবায়ন করে পাহাড়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে যাবেন যাতে আগামী যে সরকার আসুক না কেন সেই সরকার যাতে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারে।
পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গুলোর হাতে এখনো অনেক ভারী ভারী অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমার, চীন, ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই অস্ত্র গুলো তাদের হাতে আসছে বলেও নিরাপত্তা বাহিনী সুত্রে জানা গেছে। এই অস্ত্র গুলো উদ্ধারেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল।
এছাড়া বর্তমান অন্তবর্তীকালীণ সরকারের আমালে পাহাড়ের শান্তি চুক্তিবাস্তবায়নে কতটুকু উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং আগামী নির্বাচিত সরকার আসলে যারা এই চুক্তির বাস্তবায়নের ঘোর বিরোধিতা করেছে কালো চুক্তি বলে আখ্যা দিয়েছে তারাই বা কতটুকু বাস্তাবয়নে এগিয়ে আসা এটা এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন পাহাড়ের বিশ্লেষকরা।