সাইবার আইনের সব মামলা প্রত্যাহার চেয়ে যৌথভাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৪৩ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- পতিত স্বৈরাচার হাসিনার আমলে করা ও জুলাই বিপ্লবের পর বাতিল হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে থাকা সব মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিসের ট্রায়ালওয়াচ ইনিশিয়েটিভ ও বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) যৌথভাবে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় ও আমেরিকান সময় সকালে শ্বেতপত্রটি এই দুই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের অধীনে থাকা সকল মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিত। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দেশের কঠোর সাইবার আইনগুলোর পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ।

সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি সাইবার আইনের আওতায় থাকা সকল মতপ্রকাশ সম্পর্কিত মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা যথার্থ দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বহুদিন ধরে এমন কিছু আইন প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো আপত্তিকর মন্তব্য, মিথ্যা তথ্য, কিংবা এমন কোনো তথ্য যা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে ইত্যাদি সংবেদনশীল শব্দগুলোর অস্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে আইনের মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে।

প্রকৃত অর্থে এসব আইনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছিল এবং গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এসব আইন প্রথমে ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, পরে এটি ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ)- এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও প্রতিটি নতুন আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছে এটি আগের তুলনায় সংস্কার করা হয়েছে, মূলত আইনগুলোর প্রায় সকল ধারা বা নিষেধাজ্ঞা একই রকম রয়ে গেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে, সিএসএ (সর্বশেষ সংস্কার করা আইন) মূলত ডিএসএ- এর প্রায় সব কঠোর বিধানকেই নতুন করে যুক্ত করেছে, যার মধ্যে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যদিও ৫৭ ধারা ও ডিএসএ বাতিল করা হয়েছে, তবুও সরকারি তথ্য অনুসারে, ডিএসএ ও আইসিটি আইনের অধীনে দায়ের করা এক হাজারেরও বেশি মতপ্রকাশ সম্পর্কিত মামলা এখনো চলছে। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ট্রায়ালওয়াচের পর্যবেক্ষণে থাকা একটি মামলাও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, হ্যাকিং, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য গুরুতর সাইবার অপরাধের বিচার হওয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা আইন অত্যন্ত অস্পষ্ট ও প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে বিরোধী মতকে দমন করার অনেক উপাদান রয়েছে। তাই আমরা এ আইনের অধীনে দায়েরকৃত সব মামলাকে বাতিল করার আহ্বান জানাই।

যৌথ এই শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে এখন আইসিটি আইনের অধীনে থাকা সব মামলা বাতিল করা উচিত, কারণ এগুলোর আর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সাধারণ আইন অনুসারে যখন কোনো আইন বাতিল করা হয়, তখন তা কার্যত অতীত হয়ে যায়। তবে, ডিএসএ-তে একটি সংরক্ষণ বিধান ছিল, যা সেই সময় আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোকে বাতিল না করে বহাল রেখেছিল। এরপর যখন ডিএসএ আইন বাতিল করে সিএসএ করা হলো, তখন ডিএসএ আইনের জন্যও একটি সংরক্ষণ বিধান রাখা হলো, যা ডিএসএ আইন বাতিল হলেও সে আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোকে বহাল রেখেছে। কিন্তু, ডিএসএ বাতিল হয়ে যাওয়ায় আইসিটি আইনের জন্য থাকা সংরক্ষণ বিধানটি স্বাভাবিকভাবেই আর কার্যকর থাকে না।

সিএসএ-তে একই রকমের সংরক্ষণ বিধান থাকলেও এটি শুধুমাত্র ডিএসএ-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং আইসিটি আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই, আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলো এখনও বিদ্যমান থাকার আর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ট্রায়ালওয়াচের বিশেষজ্ঞ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট রেবেকা মামেন জন বলেন, আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বাতিল হয়ে যাওয়া আইনের অধীনে থাকা পুরোনো মামলাগুলোকে পুনরায় বহাল রাখা অনুচিত। বিশেষ করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্ব করতে এ আইন ব্যবহার করা স্পষ্টতই আইনের অপব্যবহার।

আপত্তিকর তথ্য, ভুয়া খবর ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা এ সম্পর্কিত অস্পষ্ট বিধান ও আইনগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আদালত আপত্তিকর মন্তব্য ও ভুয়া খবর সম্পর্কিত আইন বাতিল করছে, যার মধ্যে ভারত, উগান্ডা, কেনিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার আদালতও রয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোও দীর্ঘদিন ধরে অস্পষ্ট ভাষায় প্রণীত এসব আইনের সমালোচনা করে আসছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, যেখানে তারা দেশের আইন ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে। সুতরাং, অবিলম্বে আইসিটি আইনের অধীনে থাকা সকল মামলা বাতিল করা উচিত। ট্রায়ালওয়াচ ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কে ট্রায়ালওয়াচ বিশ্বব্যাপী যাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন, বিশেষত সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী, নারী, এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চলা ফৌজদারি মামলা পর্যবেক্ষণ করছে। ৪০টিরও বেশি দেশে ট্রায়ালওয়াচ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা অনেকক্ষেত্রেই নির্যাতিতদের মুক্তি ও খালাস লাভ এবং কঠোর আইন সংস্কারে ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে ট্রায়ালওয়াচ একটি বৈশ্বিক বিচারসূচক তৈরি করছে, যা বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে বিচার ব্যবস্থার র‌্যাঙ্কিং নির্ধারণ করবে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ সম্পর্কে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বাংলাদেশে একটি স্বাধীন, অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সিজিএস দেশের দ্রুত পরিবর্তিত অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সুশাসন, নিরাপত্তা এবং দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখার লক্ষ্যে কাজ করছে। তারা সরকার, বিদেশি সংস্থা, ব্যবসা এবং ফাউন্ডেশনের সাথে নিবিড় সহযোগিতায় কাজ করে দেশের সুশাসন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions