স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ‘টাকার অভাব’ স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৮ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:-চলতি অর্থবছর দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনায় অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত জুনে এটি অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। এখনো সেটি হয়নি। এই অর্থবছরে অনুমোদন না-ও হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। এতে সারা দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচসিপির বেতন হচ্ছে না। বেতন বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্য প্রশাসন ও হাসপাতালে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ক্লিনার, নিরাপত্তা কর্মীরা অনেকেই চলে গেছেন। অনিশ্চিত টিকাদান, কৃমি নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ‘এ’ ক্যাম্পেইনের মতো জাতীয় কর্মসূচি। বন্ধ হয়ে গেছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য খাতের এমএসআর (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিক্যুইজিট) সব কেনাকাটা। এতে চিকিৎসা নিতে রোগীর ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে।

গত ১২ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভূতপূর্ব মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন জানান, এই বছর ওপি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগামী এপ্রিল নাগাদ ওপি অনুমোদন হতে পারে। এতে এই অর্থবছরের দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নমূলক সব কাজই একপ্রকার অনিশ্চিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ মোট ১২টি ওপির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এগুলো হলো-১. কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি), ২. নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি), ৩. হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচএসএম), ৪. অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি), ৫. লাইফস্টাইল অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন (এলঅ্যান্ডএইচএ), ৬. টিবি লেপ্রোসি অ্যান্ড এসডিটিএইডস প্রোগ্রাম (টিবিএল অ্যান্ড এএসপি), ৭. কমিউনিটি ক্লিনিক অ্যান্ড হেলথকেয়ার (সিবিএইচসি), ৮. পিএমআর (প্রাইমারি হেলথকেয়ার), ৯. হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড

ই-হেলথ, ১০. উপজেলা হেলথকেয়ার (ইউএইচসি), ১১. ন্যাশনাল নিউট্রেশন সার্ভিস (এনএনএস), ১২. ম্যাটারনাল, নিউবর্ন, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্ট হেলথ (এমএনসিঅ্যান্ড এইচ)।

কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথকেয়ার প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, চার মাস ধরে তারা বেতন পাচ্ছেন না। এতে সিএইসপিদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। অন্য আনুষঙ্গিকও প্রায় শেষ। এ অবস্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এখন তারা সেই অপেক্ষায় আছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অধিদপ্তরে কোনো ক্লিনার নেই, বন্ধ হয়ে গেছে প্রকল্পের পুরোনো গাড়িগুলোর জ্বালানি ও চালকের ব্যবস্থা। এই করুণ চিত্র শুধু অধিদপ্তরেই নয়, দেশের সব উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও। অর্থ বরাদ্দ না হলে এ বছর র্যাবিস (কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক) টিকা, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের টিকা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা কেনা হবে না। ফলে বিগত অর্থবছরে কেনা টিকার মজুত ফুরিয়ে গেলে দেশের মানুষকে এসব টিকা বাজার থেকে কিনে ব্যবহার করতে হবে। তবে এগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়ায় সবার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বছরে দুবার ভিটামিন এ ক্যাম্পেইন ও কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালন একেবারে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ও রাতকানা নির্মূলে এই দুটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন অতি জরুরি। এ ছাড়া সাপে কাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনম, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়ার ওষুধ কেনাও পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না অ্যান্টিক্যান্সার ওষুধ, সারা দেশের এনসিডি কর্নারগুলোও শূন্য প্রায়।

একজন লাইন ডিরেক্টর বলেন, অপারেশনাল প্ল্যান না থাকায় এখন কোনো ডোনার এজেন্সিও সহযোগিতা করতে পারছে না। কারণ, প্রকল্প বা অপারেশনাল প্ল্যান ছাড়া উন্নয়ন খাতে টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই। তা ছাড়া উন্নয়নকে কখনো রাজস্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর আগে কভিড মহামারি, বছর বছর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ, বন্যা, খরা ও শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা করা হতো ওপির টাকা দিয়ে। এবার ওপি না থাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। আসন্ন শীতকালের রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া, নিপাহ, সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাকক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ), শিশুদের নিউমোনিয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ছাড়া মরণব্যাধি এইডস ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি মুখ থবড়ে পড়বে। এতে এই ভয়াবহ রোগগুলো ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ইউএইচসি ওপি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হতো। যেটি এখন বন্ধ আছে। একইভাবে সারা দেশের উপজেলা হাসপাতালে অটো অ্যানালাইজার দেওয়া আছে। যেগুলোর রি-এজেন্ট না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ আছে। এ ছাড়া গাড়ির জ্বালানি ব্যয় এবং চালকের বেতনও বন্ধ আছে। ওপি অনুমোদন না হওয়ায় উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বর্তমানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) শিশু, কিশোরী ও নারীদের ১১টি মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব এক বছর বয়সী শিশুদের পূর্ণ টিকার প্রাপ্তির হার ২০০৯ থেক ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইপিআই দেশে পূর্ণ টিকাদান কভারেজ শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বজায় রাখার ফলে শিশুমৃত্যুর হার বহুলাংশে হ্রাস পায়, যা এমডিজি-ফোর অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ টিকাদান কাভারেজ বজায় রাখার মাধ্যমে এরই মধ্যে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যু হার ২০১৭ সালের প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ৪৩ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২২ সাল নাগাদ প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ৩১-এ নেমেছে। এই কার্যক্রম পরিচালিত হয় এমএনসিঅ্যান্ডএইচ ওপির মাধ্যমে। ওপি অনুমোদন না হলে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে টিকাদান। এমন শঙ্কা সবার। তবে ইপিআই কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, টিকা কেনার টাকা তিনি ব্যবস্থা করেছেন। কত শিশুকে টিকা দেওয়া হবে বা সব ধরনের টিকা দেওয়া হবে কি না, সেটি তিনি বলতে পারেন না।

রাতকানা প্রতিরোধে বিগত বছরে ক্যাম্পেইনের আওতায় ৬-১১ মাস বয়সী ২৫ লাখ শিশুকে এবং ১২-৫৯ মাস বয়সী প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ শিশুকে বয়স অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো হয়েছে। প্রতি বছর দুই ধাপে এটি পরিচালিত হয়। তবে এ অর্থবছরে সেটি হবে কি না, কেউ জানে না।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য মতে, ২০১৫ সালে শনাক্ত রোগী ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জনে; এর মধ্যে ২ হাজার ৪৩৭ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। শনাক্ত রোগীর মধ্যে ৫৬ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর) রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭২৯। ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয়েছিল প্রতি লাখে ৪৫ জনের। ২০২৩ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৫ জন। সে হিসাবে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৪২ শতাংশ কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ওপি অনুমোদন না হলে দেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। বাড়বে সংক্রমণ ও মৃত্যু।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, যে ওষুধ মজুত আছে, তাতে আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু সারা দেশের নিয়োগকৃত টেকনোলজিস্ট, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং গাড়ির জ্বালানি গত জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ওপি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন ওপি না হওয়া পর্যন্ত পুরোনো ওপির বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে হবে রোগীর স্বার্থে। অন্যথায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যর্থ হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওপি অনুমোদন না করা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। কারণ শিশুদের টিকা, জরুরি ওষুধ, নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ইত্যাদি জরুরি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদন করা উচিত। বাকি বড় প্রকল্প ও উন্নয়নকাজগুলো এক দুই সপ্তাহের মধ্যে রিভিউ করে গুরুত্ব বিবেচনায় বাদ দেওয়া বা পরবর্তী সময়ে অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু রাজস্ব খাতে উন্নয়নমূলক কাজের কোনো বাজেট ধরা নেই, তাই ওপি অনুমোদন না করা হবে বড় ভুল।কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions