ডেস্ক রির্পোট:- ১৮ বছর দেশের মানুষ কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট সাফল্য এসেছে। ভারতের পুতুল শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন দিল্লিতে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। গোটা বিশ্ব যাকে একনামে চেনেন সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব নোবেলবিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ায় খুলে গেছে স্বপ্নের দুয়ার। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস হলো আজ। সাফল্য দেখানো এই দুই মাস সময় যে কোনো সরকারের জন্য সামান্যই; তবে ‘মর্নিং সোজ দ্য ডে’ মতোই আগামীর বার্তা পাওয়া যায়। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রধান উপদেষ্টার শপথ নিয়েই ২৪ ঘণ্টার ‘হাসিনার সাজানো বাগান প্রশাসন’ তছনছ করে দিয়েছিলেন। দেশের এব বিদেশে থাকা বহু প্রবাসীর কষ্টার্জিত রক্ত ঝড়ানো দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের দুই মাস পূর্তিতে দেশের ছাত্র-জনতা প্রবাসীরা সবাই হিসাব মেলাচ্ছেন, সাফল্য খুঁজতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির চেতনা নিয়ে রয়ে গেছে বিতর্ক। ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে কাগজে-কলমে; অথচ নির্বিঘ্নে হাসিনার দোসররা ভারতে পালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে তাদের মাঠে আড্ডা-বাজার করার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে, অথচ প্রশাসন নির্বিকার! যাদের ব্যবহার করে হাসিনা এত অপকর্ম করেছেন সেই কতিপয় আমলা এখনো বহাল তবিয়তে প্রশাসনে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। অন্যদিকে আমলা, সেনা, পুলিশ প্রশাসনে কর্মরত থাকায় হাসিনার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে হলেও ভারতের সহায়তায় ‘তিনি’ ফিরে এসে প্রতিশোধের হুঙ্কার দিচ্ছেন। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ছাত্র-জনতার সমর্থন ধরে রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন? নাকি হাসিনা চেতনায় বিশ্বাসী আলমাদের দিয়ে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? গোটা বিশ্বে ড. ইউনূস পরিচিত মুখ। তবে তাকে (প্রধান উপদেষ্ঠা) বুঝতে হবে দেশের মানুষই তার ক্ষমতার শক্তি। আমলা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে ক্ষমতায় আনেননি। রাজপথে রক্ত ঝরানো ছাত্র-জনতার সমর্থনে তিনি ক্ষমতায়। এই ছাত্র-জনতা তথা মানুষের ভাষা বুঝতে হবে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘ড. ইউনূসের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ।’ জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে দেখা গেছে, একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্বদরবারে ড. ইউনূসের অবস্থান কত উঁচুতে। ক্ষুদ্রঋণের জনক ড. ইউনূস বিশ্বের দেশে দেশে সফল ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনেতাদের কাছে উজ্জ্ব¡ল নক্ষত্র। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বরেণ্য ইমেজ ও মেধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে তিনি ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ আসনে বসতে পারেন। স্বাধীন দেশের মানুষ ১৮ বছর ধরে মানুষ ভোট দিতে পারছে না। আবার পিন্ডির শৃঙ্খল ভেঙে ১৮ বছর ধরে দিল্লির দাসত্ব করছে। হাসিনা সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। অতএব সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বৈকি; তবে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া আরো জরুরি। ড. ইউনূস ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দিয়ে সব ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে দৃঢ় সংকল্পে সিদ্ধান্ত্রে নির্বাচনী রোডম্যাপ অ্যাজেন্ডায় এগিয়ে যেতে হবে। বুঝতে হবে বিদেশি কোনো শক্তির বিপ্লবে ৫ আগস্ট সাফল্য আসেনি। দেশের তথাকাথিত বুদ্ধিজীবী, আমলা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি রাজপথে আন্দোলনে নামেনি। ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরানো আন্দোলন এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী দানব হাসিনাকে পরাভুত করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। ‘আগে সংস্কার পড়ে নির্বাচন’ কেতাবি চেতনা পরিহার করে জনগণ কি চায় সেটা আগে বুঝতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু করেই ‘ভোটের মহাসড়কে’ উঠার পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। কারণ বাংলাদেশ জোয়ার ভাটার মতোই। মানুষ কখন কি করেন আন্দাজ করা মুশকিল। তাছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকার নয়। আগামীতে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবেন তারাই বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক বৈধতা দেবেন।
১৫ বছর ধরে গড়ে তোলা হাসিনার অনুসারীরা প্রশাসনের পরতে পরতে সক্রিয় রয়েছেন আর ভারতে বসে তিনি একের পর এক ষড়যন্ত্রের কার্ড ছুড়ছেন। হুমকি দিচ্ছেন, ‘ড. ইউনূস এক মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’ অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘ফাইল’ টেবিলে চাপা দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করছেন। এ যেন কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গান ‘হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়’-এর মতো। সংস্কারের ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। এখন কি সংবিধান পরিবর্তনের সময়? মানুষ চায় নির্বাচন আর এনজিও মার্কা উপদেষ্টারা চায় সংবিধান সংশোধন! প্রশাসনে এখনো শেখ হাসিনার অনুগত আমলারা জেঁকে বসে আছেন। পুলিশসহ অন্যান্য সেক্টরেও তাই। প্রশাসনে বদলি, পদায়ন, নিয়োগ, ইত্যাদির নামে যা হচ্ছে তার সবই প্রায় হাসিনা অনুগতদের হাতেই যাচ্ছে; আর চটকদার নিউজ খবরে প্রকাশ পাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেনের খলনায়কদের অন্তর্বর্তী সরকারে পদায়ন হচ্ছে। ভারতের তাঁবেদার ওয়ান-ইলেভেনের ওই আমলা-কামলারাই যেন ড. ইউনূসের সরকারকে সফল করবে! সর্ষের ভেতরেই ভূত রেখে সেই সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা! ওয়ান-ইলেভেনের মতোই এখন প্রশাসনে মেকানিজন হচ্ছে। সব কিছু যেন ভারতের মাস্টারমাইন্ড ‘বিএনপি ঠেকাও’ চেতনা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করলেও কারা নির্বাচিত হবেন আগেই তা চূড়ান্ত করেছিল একটি মহল। ফলে জনগণ ভোট দিলেও ওই নির্বাচনে জনগণের ভোটের প্রতিফলন ঘটেনি। ২০১৪ প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের নির্বাচন ও ২০২৪ সালের ডামি প্রার্থীর নির্বাচনের নামে সার্কাস হয়েছিল। গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার যারা কেড়ে নিয়েছিল সেই কাজী রকিব উদ্দিন গং, নূরুল হুদা গং ও কাজী হাবিবুল আউয়াল গংদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। টিভির টকশোতে তাদের কেউ কেউ নিরপেক্ষ ভোটের ছবক দিচ্ছেন। এখনো গ্রেফতার করা হয়নি মুন সিনেমা হল নিয়ে মামলায় শেখ হাসিনার আঙুলের নির্দেশে সাংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়ার রায় দেয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে। তিনি দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেন। গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইমেজে কালিমা লেপন করেছেন। অবসরে গিয়ে ওই বিতর্কিত রায়ের পুরস্কার হিসেবে তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ পান। তিনি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আলী ইমাম মজুমদার, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. ইফতেখারুজ্জামানরা ওয়ান-ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর অনেক কামিয়েছেন। ভারতের স্বার্থরক্ষায় এদের অনেক কারুকার্য রয়েছে। এদেরকে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে এবং বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ‘কর্মময় জীবনে যাদের ভারতের স্বার্থ বিবেচ্য’ তারা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবেন? প্রফেসর আলী রিয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তিনি সেখানেই বসবাস করেন। দেশের শত শত সংবিধান বিশেষজ্ঞ বাদ দিয়ে তাকে সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো কারো হস্তক্ষেপে হয়েছে নাকি লবিং করে তারা চেয়ারে বসেছেন? শেষ বিকেলে সব কিছুর দায় তো ড. ইউনূসের ঘাড়ে বর্তাবে। ড. ইউনূস ও তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইউনূস সেন্টারের কর্মকর্তারা কি বিষয়টি অনুধাবন করছেন না?
সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী ‘ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসি’ নামের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ড. ইউনূসকে আমি চিনি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো অনুষ্ঠানে তার নাম বললেই আর পরিচয় করে দিতে হয় না। এক নামে বিশ্ব তাকে চেনে এবং জানে। আমার বিবেচনায় তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে প্রশাসন সে প্রশাসনে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থা তার নেই। কারণ তিনি অত্যান্ত ভালো মনের মানুষ। ভালো মানুষ দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের শাসন চলে না।’ তাহলে কি ড. ইউনূসকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না? এই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের ইমেজ ব্যবহার করে অন্যেরা স্বার্থ হাসিল করছেন? প্রশ্নটা হাজারা বিলিয়ন ডলারের।
হাসিনা পালানোর পর প্রবাসীরা দুহাত ভরে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে গতি ফিরে এসেছে। গার্মেন্টস নিয়ে এখনো ভারতের ষড়যন্ত্র চললেও অন্যান্য সেক্টরে ব্যবসায় গতি এসেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ঢাকায় যানজট বেড়েছে। পুলিশের যার গণহত্যা করে পালিয়ে রয়েছে তাদের গ্রেফতার করা হয়নি; বরং অভিযোগ রয়েছে তাদের ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, আইন, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতি আসেনি। উপদেষ্টারা কার্যকর পদক্ষেপ তথা ‘হাসিনার তাঁবেদার কর্মকর্তা মুক্ত’ করতে পারেনি; বরং এনজিও মার্কা কোনো কোনো উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়ে হাসিনার অনুগত আমলাদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের কাদের তদারিক কেন্দ্রীয়ভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় করছে বলে মনে হয় না। সেটি হলে প্রশাসনে গতি আসার কথা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো বৈঠক করেছে। বৈঠকে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিএনপি স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এখনো প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সর্বত্র হাসিনার দোসররা সক্রিয়। উপদেষ্টাদের মধ্যেও এমন দুয়েকজন রয়েছেন যারা গণঅভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগ দিতে বিলম্ব নিয়েও কথা বলা হয়। সংলাপে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির এমন এক নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন নির্বাচনই তার সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। বিগত তিনটি নির্বাচন কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ওই তিনটি নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে পারেনি। প্রহসনের নির্বাচনের জন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনের আমলা, পুলিশ প্রভৃতিই দায়ী। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যৌক্তিক সংস্কার অত্যাবশ্যক। ইতোমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের সবকিছু সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে না। সময়ক্ষেপণ না করে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে যতটুকু প্রয়োজন তা সম্পন্ন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। কারণ নির্বাচিতরা ক্ষমতায় এসে সবকিছু সংস্কার ও বাস্তবায়ন করতে পারবে।
ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে হাসিনাকে বিদায় করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আন্দোলনে হাজারেরও বেশি ছাত্রজনতা শহীদ হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হিসেবে শহীদের সংখ্যা দেড় হাজার। তবে গতকাল স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন ৭৩৭ জন। আহত হয়েছেন ২৩ হাজার। চোখ হারিয়েছেন ৪০০ জন, এদের মধ্যে দুই চোখ হারিয়ে একেবারে অন্ধ হয়েছেন ২০০ জন। গুরুতর আহত হয়েছেন ৮০০ জন, হাত হারিয়েছেন তিনজন ও পা হারিয়েছেন ১৯ জন। পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত ২০০ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতায় গড়া প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়া উপদেষ্টারা কে কি করছেন সবাই দেখছেন। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ১০ থেকে ১৫ বছর আগে ভোটার হয়ে যারা জীবনের ভোট দিতে পারেননি সেই জেনজিরা যেমন প্রশাসনের কর্মতৎপরতা দেখছেন তেমনি সাধারণ মানুষ ও সারাবিশ্ব দেখছে। মানুষ চায়, ড. ইউনূসের করা সংস্কার কমিশনগুলোয় যেন আওয়ামী লীগের অলিগার্ক না থাকে। সংস্কার কার্যক্রম চলার সময় স্বৈরাচারের দোসর, ভারতের কেনা গোলামদের বিদায় করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগের বিলম্বের মতোই এখনো পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার কোনো পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। পিলখানায় শহীদ সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের দাবি-দাওয়া জানিয়েছে এবং শেখ হাসিনার রেজিমের কারা কারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের নাম প্রকাশ করেছে।
হাসিনাকে পরাজিত করতে বিশ্বের দেশে দেশে মিছিল সমাবেশ হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিক-ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পেইন করেছেন। হাসিনার পতনের লক্ষ্যে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে রিজার্ভ খাদের কিনারে পড়ে যায়। স্বৈরাচার হাসিনা রেজিমে যাকে কেউ রেমিট্যান্স না পাঠায় এ লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন হয়েছে দেশে দেশে। আন্দোলন করতে গিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্ধশত শ্রমিককে কারাগারে যেতে হয়েছে। তাদের পাঁচ বছর থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অবশ্য ড. ইউনূস এক ফোনের মাধ্যমেই তাদের বিদেশী কারাগার থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন।
হাসিনার পতনের আন্দোলন রাজপথ ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার যুদ্ধের নামে ১৫ বছর ধরে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে পরাভূত করতে হাসিনার অলিগার্করা রাষ্ট্রের শত শত কেটি টাকা খরচ করেছে। তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের হাজার হাজার নেটিজেন-ইউটিউবার ছাত্র-জনতার আন্দোলন ব্যর্থ করার চেষ্টা করেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধ করে। কিন্তু বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী দেশপ্রেমিক সাংবাদিক, ইউটিউবার, কন্টেন-ক্রিয়েটর এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থী-শ্রমিকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের দালালদের পরাভূত করেছে। বিশেষ করে প্রবাসী সাংবাদিকরা গ্রুপ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তোলেন। দেশপ্রেমে নির্ভিক, মেধাবী ও পরিশ্রমী লেখক-ইউটিউবার ডা. পিনাকি ভট্টাচার্য ফ্রান্সে বসে গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলেন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন হাসিনা রেজিমের হৃদকম্পন। তিনি হাসিনার অলিগার্কদের কাঁপুনি ধরিয়ে দেন। সাংবাদিক ড. কনক সরোয়ার (কনক সরোয়ার নিউজ), ইলিয়াস হোসেন, ফয়সাল চৌধুরী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার মিনার রশিদ, প্রফেসর ড. তাজ হাসমী, এবিসি ফোরামের অলিউর রহমান, সাংবাদিক মনির হোসেন, নাগরিক টিভির নাজমুস সাকিব, টিটো রহমান, টেবিল টকের হাসিনা আক্তার, শাহেদ আলম শোর সাংবাদিক শাহেদ আলম, ভারতের সাংবাদিক চন্দন নন্দী, মেজর (অব.) সুমন, মেজর (অব.) দেলোয়ার হোসেন, মেজর (অব.) শহীদ উদ্দিন, ড. মোস্তফা সরোয়ার, ফেস দ্য পিপলের সাইফুল হক সাগর, রেজা ফয়সাল চৌধুরীসহ অসংখ্য প্রবাসী ব্যক্তি হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নেত্র নিউজের তাসলিম খলিল গুম করে ‘আয়নাঘর’ রাখার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আয়নাঘর এখন ইতিহাসের অংশ। জুলকারনাইন সায়েম খানের আল-জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইমিনিস্টার ম্যান’ প্রতিবেদন দেশ বিদেশে হইচই ফেলেছে এবং হাসিনার ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছে। মুশফিকুল ফজল আনছারী জাতিসংঘ ও ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে আন্দোলনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র-জনতার পক্ষে জনমত গঠন করায় এদের অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় এবং অনেকের দেশে পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বিদেশে সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন এবং বাংলাদেশে গোলাম মাওলা রনির দু’দিকেই খেলেছেন। খালেদ জার্মানির ডয়সে ভেলেতে ‘মহিউদ্দিন খালেদ জানতে চায়’ আন্দোলনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কিন্তু আমেরিকার ঠিকানা গণমাধ্যমে গিয়ে বিভিন্ন নামে টকশো করে তিনি কার্যত শেখ হাসিনার দালালি করেন।
বাংলাদেশে থেকেও ঝুঁকি নিয়ে জিল্লুর রহমান তৃতীয় মাত্রা, মোস্তফা ফিরোজ (ভয়েস বাংলা), জাহিদুর উর রহমান, মাসুদ কামাল (কথার কথা), ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী, অ্যাডভোকেট আবু হেনা রাজ্জাকী, কর্নেল (অব.) আবদুল হক, কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের তারেক রহমান (ভারতীয় পণ্য বর্জন), কবি আবদুল হাই সিকদার, প্রফেসর ববি হাজ্জাজ, কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান (আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন), বাহাম আবদুস সালাম ঝুঁকি নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ ছাড়াও আরো অনেকে রয়েছেন যাদের অবদান ৫ আগস্টের সাফল্যের পেছনে লেখা হয়ে গেছে। অথচ পিনাকি ভট্টাচার্যসহ অনেকেই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার ভারতপ্রীতি কমকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
হাসিনার অলিগার্ক আমলাদের প্রশাসনের রেখে অন্তর্বর্তী সরকার হেসেখেলে প্রশাসন চালালেও হাসিনা ড. ইউনূসের সরকারকে উল্টাতে প্রতিদিন ফন্দিফিকির করছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য, ১৫ বছর ধরে হাসিনা দেশে লুম্পেন অর্থনীতি চালু করেছেন। লুটেরা অর্থনীতিতে টাকা দিয়ে সবকিছু করা সম্ভব। প্রবাদে রয়েছে, টাকা হলে বাঘের চোখে মেলে। কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলেন, ‘মানি ইস সেকেন্ড গড’। মাফিয়া অর্থনীতির বাংলাদেশে সবই সম্ভব। হাসিনা আর কোনো দিন রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না এমন চিন্তা থেকে উপদেষ্টাদের যারা ‘পদ নিয়ে সুখে ঘুমাচ্ছেন’ তারা বোকার স্বার্গে রয়ে গেছেন। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ, আলেকজান্ডারের ভাষায় ‘বিচিত্র এই দেশ’। হাসিনা কল্পনাও করেননি তাকে পালাতে হবে। বাস্তবতা পালিয়েছেন। হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সেনাপ্রধানের ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের ভোটে অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ইউনূসের সরকার এক মাসও টিকবে না। আমি কাউকে ছাড়ব না। দেশে এসে সবাইকে দেখে নেবো। আমি কাছেই রয়েছি চট করে দেশে ঢুকব।’ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেইজে দীর্ঘ পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রয়োজনে আরেকটি যুদ্ধ করব।’ আওয়ামী লীগের এই যুদ্ধে হুঙ্কার কার বিরুদ্ধে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হিন্দুত্ববাদী ভারত হাসিনাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে।
লুম্পেন অর্থনীতির দেশে টাকা দিয়ে যে সব সম্ভব তা ফিলিপাইনের দিকে তাকালে বোঝা যায়। বাংলাদেশের গত ৫ আগস্টে হাসিনার দিল্লিতে পালানোর মতোই ১৯৮৬ সালে আন্দোলনের মুখে ফিলপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস হাওয়াই দ্বিপে পালিয়েছিলেন ফাস্টলেডি ইমেলডা মার্কোসকে নিয়ে। সন্তানরা আগেই বিদেশে ছিল। কিন্তু সেই মার্কোসের ছেলে বংবং মার্কোস এখন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট। এর কারণ হলো লুম্পেন অর্থনীতির লুটের টাকা আর অনুগত আমলা। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছেন মার্কোস পরিবার সে দেশের রাজনীতিতে ফিরতে। এছাড়া আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীতে তার রেখে যাওয়া দুর্নীতিবাজদের টাকা দিয়ে পুনর্গঠন করেছিলেন। আবার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের মর্কোস পরিবার ঘুষ ও উৎকোচ দিয়ে কিনে নেয়। হাসিনা পালিয়েছেন বোন রেহানাকে নিয়ে। পুত্রকন্যা বিদেশেই ছিলেন। মার্কোসের মতোই হাসিনার অনুগত আমলারা এখনো প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। প্রশাসনের অন্যান্য বাহিনীতেও রয়েছে হাসিনা অনুগতরা। আর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা মন্ত্রী-এমপিদের বেচাকেনার নজির আগেও ছিল। হাসিনা ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের রয়েছে প্রচুর টাকা। প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। জয় ইতোমধ্যেই ‘স্ট্রিক গ্লোবাল ডেপ্লোম্যাসি’ নামের সিঙ্গাপুরভিক্তিক একটি লবিস্ট ফার্মকে মাসে দুই লাখ ডলার চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। ওই লবিস্ট ফার্ম মার্কিন নেতাদের আওয়ামী লীগের পক্ষে আনার লক্ষ্যে কাজ করবে। আর ভারত তো আওয়ামী লীগের হয়ে দুতিয়ালি করছেই।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ অনুগত আমলাদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা আত্মঘাতীর নামান্তর। যাদের ত্যাগ প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় স্বাধীন হয়েছে দেশ তারা হাসিনার অলিগার্কদের প্রশাসনে দেখতে চায় না। তারা গণহত্যায় অংশ নেয়া ও নির্দেশ দেয়া মন্ত্রী-এমপি-আমলা-আইনশৃঙ্খলার কর্মকর্তাদের আইনের কাঠগড়ায় দেখতে চায়। তাদের বিচার চায়। কিন্তু দু’-একজন উপদেষ্টা যেন ফিলিপাইনের মার্কোস পরিবারের মতো শেখ পরিবারকে ফের ফেরানোর চক্রান্ত করছেন।ইনকিলাব