ডেস্ক রির্পোট:- হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। ইরান এ হত্যাকান্ডের জন্য ইসরায়েলসহ যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। তারা এ হত্যার বদলা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে লেবাননে বোমা হামলার পাশাপাশি সীমান্তে বিপুল সেনা মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। গতকালও ইসরায়েল সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়ে ১২ জন ইরানপন্থি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। হামলা চালানো হয়েছে ইয়েমেনেও। লেবাননে আরেক হিজবুল্লাহ নেতা আবু আলী রিদাকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সবমিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা।
শনিবার ইসরায়েলি হামলায় নিহত লেবাননের শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল মেডিকেল ও নিরাপত্তার একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তারা বলেছেন, লাশে আঘাতের চিহ্ন নেই এবং এটি অক্ষত আছে। তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, অথবা কখন তাকে দাফন করা হবে- সে বিষয়ে কোনো কিছু জানানো হয়নি। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হওয়ার পর ‘ব্লান্ট ট্রমায়’ নাসরুল্লাহর মৃত্যু হয়েছে। ব্লান্ট ট্রমা হলো- কোনো কিছুর আঘাতে শরীরের বাইরে বড় ধরনের কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায় না। কিন্তু শরীরের ভিতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরেক খবরে বলা হয়েছে, গতকাল লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সর্বশেষ জীবিত সিনিয়র সামরিক কমান্ডার আবু আলী রিদাকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। নতুন করে লেবাননের রাজধানী বৈরুত দখলদার ইসরায়েলের হামলায় কেঁপে ওঠে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, হামলার লক্ষ্য ছিলেন আবু আলী রিদা। তিনি হিজবুল্লাহর বদর ইউনিটের কমান্ডারের দায়িত্বে আছেন। এ ইউনিটটি দক্ষিণ লেবাননের সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্সের দায়িত্বে আছে। এ ইউনিটের সেনারা সীমান্ত অঞ্চল থেকে একটু দূরে অবস্থান করেন। হিজবুল্লাহর যত সিনিয়র সামরিক কমান্ডার আছেন তাদের মধ্যে জীবিত ছিলেন শুধু আবু আলী রিদা। যদি এ হামলায় রিদার মৃত্যু হয় তাহলে হিজবুল্লাহর সিনিয়র কোনো সামরিক কমান্ডার আর বেঁচে থাকবেন না।
এ ছাড়া গতকাল সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে অজ্ঞাত বিমান হামলায় ১২ জন ইরানপন্থি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন এবং আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। খবরে বলা হয়, ‘অজ্ঞাত উৎস’ থেকে সিরিয়ার দেইর এজ- জোর শহর ও এর পূর্বাঞ্চল এবং ইরাকের সীমান্তবর্তী বোকামাল অঞ্চলে সামরিক অবস্থানগুলোতে বিমান হামলা চালানো হয়। দেইর এজ-জোর বিমানবন্দরের কাছেও পাঁচটি সামরিক অবস্থানে হামলা চালানো হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ এসব হামলার দায় স্বীকার করেনি।
খবরে বলা হয়, ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর অবস্থানগুলোতে তীব্র বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নাসরুল্লাহ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি ধ্বংসাত্মক সংঘাতের দিকে যেতে পারে। সংঘাতে জড়াতে পারে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আল-বাশা বলেন, ‘হাসান নাসরুল্লাহর নিহতের ঘটনা হিজবুল্লাহকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এখনো সশস্ত্র সংগঠনটির হাজারো যোদ্ধা রয়েছে। তাদের অনেকেই সিরিয়ায় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা প্রতিশোধের দাবি তুলেছেন। হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার বেশ সমৃদ্ধ। দূরপাল্লার ও নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে সংগঠনটির বহরে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের তেল আবিব ও অন্যান্য শহরে হামলা চালানো সম্ভব। তাই নিজেরা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে হিজবুল্লাহ এসব অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সত্যিই যদি হিজবুল্লাহ এসব অস্ত্রের ব্যবহার এবং ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানো শুরু করে তাহলে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক হবে। পাল্টা হামলায় লেবাননে ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ঘটাবে ইসরায়েল। সেই লড়াই ইরান অবধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যাতে জড়িয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রও।
সূত্র বলছে, হাসান নাসরুল্লাহর নিহতের ঘটনা হিজবুল্লাহর জন্য যত বড় আঘাত, ইরানের জন্যও ঠিক ততটাই। এ ঘটনায় পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান সরকার। হিজবুল্লাহর প্রধান নিহতের ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে ইরান। তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে অজ্ঞাত নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এইসঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের কাজ চলছে।
এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহ হত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আংশিকভাবে দায়ী করেছেন। এ ছাড়া ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ হত্যার বদলা নেওয়ার অঙ্গীকার করে বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নাসরুল্লাহর লড়াইয়ের পথ অন্যরা অব্যাহত রাখবে। মুসলিমদের ইসরায়েলকে মোকাবিলার ডাকও দিয়েছেন খামেনি। তিনি মুসলিমদের লেবাননের জনগণ এবং গর্বিত হিজবুল্লাহর পাশে থেকে তাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাপিষ্ঠ (ইসরায়েল) প্রশাসনকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, শনিবার ইসরায়েলের সেনাবাহিনী হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার কথা জানানোর পরই খামেনি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারিত হবে প্রতিরোধ বাহিনী দিয়ে, যার অগ্রভাগে থাকবে হিজবুল্লাহ।’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন ডাকারও আহ্বান জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির ইরাভানি ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা কাউন্সিলে চিঠি দিয়ে এ আহ্বান জানিয়েছেন। হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ইরান এ ধরনের হত্যাকান্ড কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আরেক খবরে বলা হয়েছে, লেবাননে এবার স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল। এ জন্য সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে চলেছে দেশটি। এ ছাড়া লেবাননে বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।
জানা গেছে, শনিবারের হামলায় লেবাননে ৩৩ জন নিহত ও ১৯৫ জন আহত হয়েছেন। গত সোমবার থেকে লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এই সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫২ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ১১৮ জন। অবশ্য ইসরায়েলে পাল্টা হামলাও চালিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি। সংগঠনটির সামরিক শাখা জানিয়েছে, ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওই বিমানবন্দরে যখন ফিরছিলেন, তখন এ হামলা চালানো হয়েছে। তবে এতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত তীব্র হওয়ায় যুক্তরাজ্য তার নাগরিকদের ‘এখনই’ লেবানন ছাড়তে বলেছে। এরই মধ্যে শনিবার লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানো এক ব্রিটিশ নারী জানান, লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, লেবাননে প্রায় ৫ হাজার ব্রিটিশ নাগরিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত কয়েক শ যুক্তরাজ্যেরই নাগরিক।