শিরোনাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব নির্বাচন চান সম্পাদকরা রাজপথে পরিকল্পিত নৈরাজ্য,হাসিনার ষড়যন্ত্রে একের পর এক অস্থিরতার চেষ্টা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হারাচ্ছেন বড় গ্রুপের প্রভাবশালীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘুষের সিন্ডিকেট,বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে দেনদরবারেও জড়িত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠনের দাবিতে রাঙ্গামাটিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকের প্রস্তুতি, হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা বিচারের পর আ.লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে-টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: জাগপা নেতা রহমত নতুন সিইসি নাসির উদ্দীনের নাম ছিল বিএনপির তালিকায় নাসির উদ্দীনকে সিইসি করে নির্বাচন কমিশন গঠন

রাজনীতির নতুন অধ্যায় লিখছেন তরুণেরা

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪
  • ১০৪ দেখা হয়েছে

আলী রীয়াজ:- বাংলাদেশে জুলাই মাসের শুরু থেকে যা ঘটেছে এবং ঘটছে, সে বিষয়ে সবাই অবগত। দেশে যাঁরা আছেন, তাঁদের এ ঘটনাবলির দুঃসহ, মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই আছে।

বাংলাদেশের বাইরে যাঁরা বাংলাভাষী নন, এমনকি যাঁরা সাধারণত বাংলাদেশের খবরাদি রাখেন না, সারা বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ছোট শহরের স্থানীয় গণমাধ্যমের কারণে তাঁরা জানেন, ১৪ জুলাই থেকে এখানে কী ঘটেছে।

সেই সূত্রে তাঁরা এটাও জানেন, এর পটভূমি কী, কীভাবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে এত স্বল্প সময়ে এত ব্যাপকসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তাঁরা সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনাও জানেন। এ নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেটাও তাঁদের এক বড় অংশই সম্ভবত অবহিত হয়েছেন।

তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া এবং টেলিফোন যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব করে তোলার পরেও প্রবাসী প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি, যাঁদের একটি বড় সংখ্যকই প্রাণপাত করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে চালু রাখেন, উন্নয়নের গল্পগাথার ভিত্তি রচনা করেন, তাঁদের দুর্বিষহ সময় কাটাতে হয়েছে। নিকটজনেরা বেঁচে আছেন কি না, কীভাবে আছেন, সেই খবরের জন্য আকুলতা দেশের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রতিদিনের বিষয় হয়ে উঠেছিল। এখনো সেই অবস্থার অবসান হয়নি।

৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমার প্রবাসজীবনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এ রকম আকুল ও উদ্বিগ্ন হয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখিনি, শুনিনি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল তাঁদের অনেকের ঘরে থাকলেও তাঁরা সেখানে প্রচারিত খবরের অসারতা বুঝেছেন। কেননা, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় তাঁরা যে খবর পেয়েছেন, তার চিত্র ছিল ভিন্ন। ভাষার দূরত্ব সত্ত্বেও এই মানুষগুলো কোনো না কোনোভাবে সেই দূরত্ব অতিক্রম করে সংবাদের সারকথা উদ্ধার করেছেন, সম্ভবত সত্য-মিথ্যার পার্থক্য অনেকটাই নিরূপণ করতে পেরেছেন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর, বিশেষত টেলিভিশনগুলো যে ভূমিকা পালন করছে, সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিবেচনায় এগুলোর অবস্থান কী, তা এত দিন যোগাযোগবিজ্ঞানের গবেষকদের, একাডেমিকদের বিষয় ছিল। কিন্তু এখন তা শুধু দেশের নাগরিকেরাই নন, প্রবাসী সাধারণ নাগরিকেরাও বুঝতে পেরেছেন।

ক্ষমতাসীনেরা সম্ভবত ভেবেছিলেন, সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেই একটিমাত্র বয়ান বিশ্বের ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে। কিন্তু তাঁরা বিশ্বায়নের যুগ ও ভিপিএনের যুগের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তথ্যের প্রাপ্যতা সংকুচিত করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তথ্যের অন্ধকারে ঠেলে দিতে পেরেছেন—এমন সাফল্য দাবি করতে পারবেন না। সম্ভবত তার উল্টোটাই ঘটেছে।

শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের কয়েকজন সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ‘প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত’ বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ যোগাযোগ বিষয়ে দীর্ঘদিন পঠন-পাঠনের সময় শিক্ষার্থী হিসেবে পাইনি।
২.

১৬ জুলাই থেকে এযাবৎ কত মানুষের প্রাণ গেছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। প্রথম আলোর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা ২১১। অন্যান্য সূত্র এই সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান রোববার এই সংখ্যা বলেছেন ১৪৭। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞের প্রধান শিকার যে দেশের তরুণেরা, সেটা এখন তথ্যের আকারেই জানা যাচ্ছে।

প্রথম আলোর করা বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে নিহত ১৫০ জনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১১৩ জন কম বয়সী (৪ থেকে ২৯ বছর)। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছরের তরুণদের ভাগ হচ্ছে প্রায় ৬৩ শতাংশ।

যেকোনো গবেষণাপদ্ধতি বলে যে আপনার স্যাম্পলের যে হার, তাকে আপনি সাধারণভাবে মোট সংখ্যার ক্ষেত্রে সেই অনুপাতে হিসাব করতে পারেন। এর অর্থ হচ্ছে, গত কয়েক দিনে যাঁদের প্রাণনাশ হয়েছে, তার প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৭ জন তরুণ।

যেকোনো দেশের ভবিষ্যৎ এবং দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ। তরুণ জনশক্তিই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এবার প্রথম আলোর হিসাবের দিকে তাকাই—নিহত ১৫০ জনের মধ্যে আছেন ১১৫ জন তরুণ; ৭৬ শতাংশের বেশি।

এই হিসাব কেবল নিহতদের, আহতদের ক্ষেত্রেও হিসাবটি এমনই হওয়ার কথা। কিন্তু এসব ঘটনার পর এখন নির্বিচার আটকের যে মহোৎসব চলছে, তার লক্ষ্য কারা? কারফিউ দিয়ে পাড়া-মহল্লায় রাতের অন্ধকারে যাঁদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের একটা বড় অংশই তরুণ।

তরুণদের হত্যা ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। আজ যা ঘটছে, তা কেবল একটি স্বৈরশাসনকে স্থায়ীকরণের চেষ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা হচ্ছে সম্ভাবনাময় একটি বাংলাদেশের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার এক অভিযান।

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে লুণ্ঠন চলছে, বাংলাদেশে যে ক্লেপ্টোক্রেটিক শাসন গড়ে উঠেছে, অবারিত ঋণের বোঝা তৈরি করে যেভাবে ভবিষ্যৎ লুণ্ঠিত হচ্ছে, তা থেকে এই তরুণদের প্রাণনাশকে ভিন্ন মনে করার উপায় নেই। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য এবং সেই পর্যায়ে উঠলে যে মানবসম্পদের দরকার, যে তরুণেরা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবেন, তাঁদের প্রাণই থাকছে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলন যে গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছে, তার একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনুসৃত নীতিগুলো চাকরি সংস্থান করতে পারেনি, সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ না আছেন পড়ালেখায়, না আছেন চাকরিতে। যেসব নীতি এই অবস্থার তৈরি করেছে, তা আকাশ থেকে পড়েনি, নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞাতে হয়নি।

শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হলগুলোতে টর্চার সেল তৈরি ও গণরুমের নামে যা ঘটেছে, তা কি কেবল ছাত্রলীগ নেতাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যই তৈরি করেছে নাকি এর মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের সব রকম পথ রুদ্ধ করার এক আয়োজনও ছিল?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনে ও শিক্ষকতায় যাঁরা ছিলেন এবং আছেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া বুঝতে পারেননি—এটা বিশ্বাস করা কি সম্ভব?

বাংলাদেশের তরুণদের পরিকল্পিতভাবেই এমন এক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা সৃষ্টিশীল হয়ে না ওঠেন। আর তা থেকে কারা লাভবান হচ্ছে—দেশে ও দেশের বাইরে তা বিবেচনা করার চেষ্টা করুন। একটি সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ যে এই অঞ্চলের প্রতিবেশীদের অসূয়ার কারণ হতে পারে, তা কি কেবল আকাশ-কুসুম কল্পনা?

বাংলাদেশের সরকার মানুষের জীবনের চেয়ে গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়েই যে বেশি ব্যস্ত, তা তাদের কথাবার্তা ও আচরণেই স্পষ্ট। অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়ে যে আলোচনা, তরুণদের একাংশের কাছে প্রশ্ন করলে জানবেন, তাঁদের কাছে একটি বিশেষ খাতের অপূরণীয় ক্ষতি—এই খাত হচ্ছে আইটি।

গত কয়েক দিনে এই খাতের ক্ষতির কারণ হচ্ছে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে একটি বিকাশমান খাত, যার সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই হচ্ছেন তরুণ—ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে কল সেন্টার—সবই যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তা হচ্ছে ক্লায়েন্টদের আস্থা। এতে যে তাঁদের ক্লায়েন্টরা আবার অন্যদিকে ধাবিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে এই খাতের বিকাশ কি কারও জন্য সামান্য হলেও হুমকি হয়ে উঠছিল?
৩.

গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনীতি যে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই অধ্যায়ের লেখক হচ্ছেন তরুণেরা।

একটি স্বাধীন দেশের যে রাষ্ট্রযন্ত্র হওয়ার কথা ছিল তাঁদের সহযোগী, সেই রাষ্ট্র এবং তার নিয়ন্ত্রকেরা তাঁদের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছেন, নিপীড়ন করছেন। তার পরও যে তাঁরা দমে যাননি, তার উদাহরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই প্রতীয়মান।

প্রবাসে থাকার সূত্রে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের যে প্রতিবাদ দেখতে পেয়েছি, তা আমার প্রবাসজীবনে অভূতপূর্ব। তাঁরা বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং তার সম্পাদকেরা যে বয়ান তৈরি করেছেন, তাকে উপেক্ষা করেই এ ভূমিকা নিয়েছেন।
আলী রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions