ডেস্ক রির্পোট:- শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে অচলাবস্থা চলছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষকরা যখন সর্বাত্মক কর্ম-বিরতিতে ঠিক তখন সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সমাধান চেয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে সারা দেশে বিক্ষোভ ও ব্লকেডের মতো কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। দুইপক্ষের এমন আন্দোলনে স্থবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। শিক্ষাসূচিতে লেগেছে বড় ধাক্কা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করা যায়নি প্রথম বর্ষের ক্লাসও। অন্যদিকে সরকার কোটার বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন বিষয় বলে এড়িয়ে গেলেও শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে কোনো ধরনের ভ্রূক্ষেপ করছে না। পহেলা জুলাই থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি চললেও এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি। এমনকি দুই মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনার সময় ঠিক হলেও শেষ পর্যন্ত আলোচনায় বসতে পারেননি শিক্ষকরা। এমতাবস্থায় শিক্ষকদের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। সর্বাত্মক কর্মবিরতি কতদিন করবেন শিক্ষকরা, সমাধান না হলে কী করবেন- এসব প্রশ্ন সামনে আসছে।
এদিকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির কারণে সেমিনার, লাইব্রেরি, প্রশাসনিক কার্যক্রমের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলো বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট শাখা বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
অনেকে জরুরিভিত্তিকে সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট তুলতে চেয়েও পারছেন না। যার কারণে চাকরির ভাইভাসহ বিভিন্ন একাডেমিক কাজে বড় ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুক্ষিণ হতে হচ্ছে তাদের। লাইব্রেরি ও সেমিনার বন্ধ থাকায় পড়ালেখায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সরকার শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যেতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মনে করেন শিক্ষকনেতারা। শিক্ষার্থীরা বলেন, সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে শিক্ষার্থীরা কতদিন পড়ার টেবিলের বাইরে থাকবেন। সরকারের সদিচ্ছাই পারে চলমান সমস্যার সমাধান করতে। আর শিক্ষাবিদদের পরামর্শ, দু’টি সমস্যা নিয়েই স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসা উচিত সরকারের। পারস্পরিক শ্রদ্ধা রেখে দুই পক্ষ আলোচনা করলে যৌক্তিক সমাধান মিলবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। গত মার্চে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগ পেতে যাওয়া কর্মীদের জন্য প্রত্যয় স্কিম চালু করে। এ নিয়মে পড়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। কিন্তু শুরু থেকেই প্রত্যয় স্কিমে যেতে আপত্তি জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ, স্মারকলিপি, মানববন্ধন ও অর্ধবেলা কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বিষয়টির সমাধান না হওয়ায় গত ১লা জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর থেকে শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও সমস্যার সমাধানে কোনো ধরনের আশ্বাস পাননি।
অন্যদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও একই দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। এমতাবস্থায় বন্ধ রয়েছে ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনকি কার্যক্রম। বিশেষ করে লাইব্রেরি বন্ধ থাকায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর বন্ধ থাকায় বিভিন্ন শাখা থেকে সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্টের মতো জরুরি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। জাহিদুল ইসলাম নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে সার্টিফিকেট প্রয়োজন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সার্টিফিকেট তুলতে পারছি না। সুমাইয়া আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আবেদন করতে আমার ট্রান্সক্রিপ্ট তোলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু লাগাতার আন্দোলনের কারণে এখনো তা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ৪ঠা জুলাই আপিল বিভাগ সে রায় আপাতত বহাল রাখেন। এরপর থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মতো কর্মসূচি পালন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। গত ১০ই জুলাই আপিল বিভাগ ২৮ দিনের জন্য হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটার যৌক্তিক সমাধান চেয়ে আন্দোলনে রয়েছেন। এমতাবস্থায় কবে নাগাদ কোটা সমস্যার সমাধান হবে আর শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরে যাবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদিকে গতকালও শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তারা এক ঘণ্টা অবরোধ শেষে আজ নতুন কর্মসূচি ঘোষণার কথা জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা হাইকোর্টের বারান্দায় যেতে চাই না। আমরা পড়াশোনায় থাকতে চাই। আমাদের একদফা দাবি না মানা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাজপথে থাকবেন। নির্বাহী বিভাগকে বলতে চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি মেনে নিন, যাতে আমরা দ্রুত পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি। যতদিন না আমাদের দাবি মেনে নেয়া হয়, ততদিন আমাদের এ আন্দোলন চলবে। আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা চলছে এ সমস্যার সমাধান সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এভাবে কতদিন চলবে। শিক্ষার্থীরা কবে ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমরা তিন দফা কর্মসূচিকে সামনে রেখে আন্দোলন করছি। প্রথমত, আমরা প্রত্যয় স্কিমে থাকবো না। কেন থাকবো না তার কারণও আমরা বলেছি। দ্বিতীয়ত, ২০১৫ সালে আমাদের সুপার গ্রেড দেয়ার যে কথা ছিল সেটি আজও দেয়া হয়নি। শিক্ষকরা তাদের যোগ্য সম্মানটুকুও পাননি। তৃতীয়ত, আমরা স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দাবি করেছি। যেটি হলে আমাদের কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকবে না। জুডিশিয়ারিতেও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল আছে। যার কারণে তাদের আন্দোলনে যেতে হয় না। আমরা জানি এ বিষয়টির রাতারাতি সমাধান সম্ভব না। তবে এর জন্য একটি কমিশন করার যে প্রক্রিয়া সেটিও হচ্ছে না। আমাদের আন্দোলন কি যৌক্তিক না? ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু আজও হয়নি। আমাদের দাবিগুলো মেনে নিলে আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো। সমস্যার সমাধানে সরকার থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে অফিসিয়াল যোগাযোগ হয়নি। তবে আন অফিসিয়ালি যোগাযোগ আছে। মনে করি এটা দ্রুত সমাধান হবে। তিনি বলেন, কোটার যৌক্তিক সমাধানও করা উচিত। এটার বিষয়ে ইতিমধ্যে আপিল বিভাগ ২৮ দিনের একটি স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। তাই শিক্ষার্থীদের সে কয়দিন অপেক্ষা করা উচিত বলে মনে করি। সরকার আন্তরিক এটার সমাধান করতে। তাই শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রফেসর নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, সরকার কোটা নিয়ে যেভাবে আলোচনা করছে আমাদের বিষয়টিরও সেভাবে যৌক্তিক সমাধান হবে বলে আশা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সঙ্গে সরকারের উচিত আলোচনায় বসা। তাহলে একটা সমাধান আসতে পারে। শিক্ষার্থীরা যে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে রয়েছে সেটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তাই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরও অপেক্ষা করা উচিত। আপতত আন্দোলনে গিয়ে এর সমাধান মিলবে না। তার ওপর অবরোধের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে তারা। এতে দেশবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের আপতত কিছু করার নেই। যেহেতু ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্রটি এখনো জারি রয়েছে তাই শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করা উচিত। সব মিলিয়ে সরকারের উচিত জরুরিভিত্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। যাতে তারা বিষয়টি বুঝতে পারে। খোলামেলা আলোচনা হলে এর সমাধান আসতে পারে। অন্যদিকে শিক্ষকরা প্রত্যয় স্কিম নিয়ে যে আন্দোলন করছেন সেখানেও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমাধান করা উচিত। তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অচলাবস্থা কেটে যাবে বলে আশা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এসএম ফায়েজ বলেন, উদার মনোভাব নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত সরকারের।
সম্মান রেখে এক পক্ষ অপর পক্ষকে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলে আলোচনাটা ফলপ্রসূ হবে। শিক্ষকরা প্রত্যয় স্কিম নিয়ে আন্দোলনে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাই সরকারের উচিত দেরি না করা। শিক্ষকদের ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনায় বসা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও আলোচনা করা। এখানে কমিউনিকেশন গ্যাপ রাখা যাবে না। কমিউনিকেশন গ্যাপ দূর করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে। কারণ এরা স্বাধীন কাজ করতে পছন্দ করে। তারা কোনো দলের হয়ে মাঠে আছে বলে আমি মনে করি না। এ বয়সে তারা এক ধরনের ইমোশনাল ও স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত নিতে চায়। শ্রদ্ধার মাধ্যমে আলোচনা হলে দ্রুত সমাধান হবে। শ্রদ্ধা রেখে আলোচনা করলে এর সমাধান আসে। আমাদের ছেলেরা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে রাজপথে আছে অবশ্যই এটা দেখে আমরা ভালো ফিল করছি না। এমনকি তাদের বাবা-মায়েরাও এমনটা চান না। তারা চান তাদের ছেলে-মেয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে দ্রুত। আমরাও সেটা চাই। তাই যত দ্রুত আলোচনার টেবিলে বসা যায় তত দ্রুত এর সমাধান আসবে। মানবজমিন