ডেস্ক রির্পোট:- ঢাকাই সিনেমা ‘ঘাটের মাঝি’তে এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিনের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘মন দিলাম প্রাণ দিলাম; আর কি আছে বাকি! ও আমার কাজল পাখি পরাণ পাখি; ও আমার সুজন মাঝি, ও আমার ঘাটের মাঝি’ গানের কথা মনে আছে? বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতকে রেল করিডোর দেয়ার খবরের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা এ গানটি ব্যাপক শেয়ার, লাইক দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একটি চিঠি লিখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। সেই চিঠি নিয়ে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হৈচৈ পড়ে গেছে। রহস্য কি? রহস্য আর কিছুই নয় মমতা ব্যানার্জি জানিয়ে দিয়েছেন গঙ্গা (৩০ বছরের ফারাক্কা চুক্তি নামে পরিচিত) ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে নিয়ে তিনি আপস করবেন না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ খবর প্রকাশের পর মমতা এই চিঠি লেখেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন তিনি রাজ্যের ক্ষতি হয় এমন চুক্তি করতে দেবেন না। অথচ দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। গত ২৫ জুন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে রেল করিডোর দেয়াসহ নতুন ১০ চুক্তি ও স্মারক সইয়ের পক্ষ্যে সাফাই গেয়েছেন। প্রশ্ন হলো গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের চুক্তির সংখ্যা কত? দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। তবে ২০১৮ সালের ভারত সফরে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করে দেশে ফিরে ৩০ মে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে দিল্লি সফরের সাফল্য তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে যা দিয়েছে, দেশটিকে তা সারা জীবন মনে রাখতে হবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি, গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।’ এক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘ভারতের কাছে আপনি কোন প্রতিদান চেয়েছেন কিনা? চাইলে কোনও আশ্বাস পেয়েছেন কিনা।’ জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেয়ার অভ্যাস বেশি।’
ভারতকে সবকিছু উজার করে দেয়া হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে রয়েছে। অথচ ফেনি নদীর পানি চুক্তি করে ত্রিপুরায় ফেনি নদীর পানি উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে রয়েছে। তিস্তÍা নদীর পানি ব্যবহারে চীন মহাপ্রকল্প করার প্রস্তাব দিলেও ভারত সেখানে বাগড়া দিচ্ছে। ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। এমনিকেই চুক্তি মোতাবেক ভারত কখনো পানি দেয়নি। ফারাক্কা চুক্তি নবায়নেরও বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে মমতা ব্যানার্জি। ফলে ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন না হলে দেশের আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অথচ ভারত যা চাইছে সঙ্গে সঙ্গে তা দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, ফারাক্কা ব্যারেজসহ অন্যান্য বাঁধ বা ব্যারেজ চালুর মাধ্যমে ভারত পানি সম্পদকে মরণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬ কোটিরও বেশি মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মারছে। বর্ষা মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেয়। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে দিয়ে পানিশূন্য করে এদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে। ফারাক্কা ব্যারেজের কারণেই দেশের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল নদী মৃত্যুর মুখে। গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের সাথে পানির এ সমস্যা বললেই সমাধান করা সম্ভব নয়। এটা সমাধান করতে হলে রাজনৈতিকভাবে করতে হবে।
মরণদশায় দেশ : মরণ বাঁধ ফারাক্কাসহ আরও অন্যান্য বাঁধ বা ড্যামের মাধ্যমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের প্রায় সব নদ-নদীরই এখন মরণদশা। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ফরিদপুর, রাজশাহী ও পাবনার ওপর দিয়ে প্রবাহিত অর্ধ-শতাধিক নদী, হাজার হাজার পুকুর, অসংখ্য খাল বিল বাঁওড় গ্রীষ্মকাল আসার আগেই শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে। কপোতাক্ষ, গড়াই, চিত্রা, মাতামহুরি, মধুমতিসহ ওই অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর। আর এসব চর এখন ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। কোথাও বা নদীর বুকে শিশুরা ক্রিকেট খেলে। নদী মরে যাওয়ায় নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাও মারাত্মক হুমকির মুখে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে মৎস্য সম্পদ। সেই সাথে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপর। কৃষিপ্রধান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। পদ্মায় পানি না থাকায় কুষ্টিয়ায় দেশের বৃহৎ গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প বন্ধ। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা লের ৪ জেলার প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে বিরত। তাতে বিপদ আরো বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। ঘটছে পরিবেশগত বিপর্যয়। নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মাছ হয়ে উঠছে অমূল্য পণ্য। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার করা জেলে-মাঝিদের জীবনধারা বাস্তব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বৃহত্তর যশোরের জেলাগুলো, খুলনার তিনটা জেলা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, এমনকি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এগুলোর ভাগ্য সরাসরি গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া বরগুনা, পিরোজপুর, বরিশাল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, এসব জেলার নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি ভেতরে ঢুকছে। এতে লবণাক্ত হচ্ছে বিপুল এলাকা। বদলে যাচ্ছে ইকোসিস্টেম। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ৫০ বছর পর সুন্দরবনে একটা সুন্দরীগাছও থাকবে না। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরগুনা থেকে মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাজশাহী, মরণ বাঁধ ফারাক্কার কারণে পদ্মা শুকিয়ে এথন মরা নদী। পদ্মার বুকে ধু ধু বালুচর। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে। পদ্মায় পানি না থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুতই নিচে নেমে যাওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বরেন্দ্র অঞ্চল। যার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্রসহ জনজীবনে। চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চল এতই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, এই অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পানি নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলে আসলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। একই অবস্থায় তিস্তার পানি নিয়েও বিভিন্ন মহলে জোর তৎপরতা চললেও শেষ পর্যন্ত তা পদ্মার মতোই অকার্যকর। এদিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মা, মহান্দা, পূর্ণভাবা, পাগলা, আত্রাই নদীসহ অসংখ্য খাল-বিল, পুকুর ও নালা শুকিয়ে যাওয়ায় রাজশাহীসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
ফারাক্কা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, কল কারখানা নৌ, জীববৈচিত্র সর্বক্ষেত্রে উত্তর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে কৃষির উপর। ফারাক্কা দিয়ে পদ্মাকে মেরে ফেলার কারণে এ অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ সেচের পানির অভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধেয়ে আসা মরুময়তা থেকে রক্ষা ও সেচ ব্যাবস্থা চালু রাখার জন্য ১৯৮৬ সালে বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি সংস্থা যাত্রা শুরু করে। বরেন্দ্র এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ একর জমিতে নিয়মিত সেচ সুবিধা আনা, ভূগর্ভস্থ পানি তুলে শুরুতে তিন হাজার গভীর নলকূপ বসানোর মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থা চালু করা। বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে যে মরুময়তা ধেয়ে আসছিল তা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি নেয়। শুরুতে ২৫ উপজেলা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো উত্তরাঞ্চলজুড়ে চলে কার্যক্রম।
একদিকে খাদ্য, মৎস্য বনায়ন মানুষের জীবনধারনের জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তোলা শুরু হয়। অন্যদিকে পদ্মার বিশাল বালুচরের নিচে চাপাপড়া। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে নামতে ত্রিশফুট থেকে দেড়শো ফুটে নেমে যাওয়া বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া। যে পরিমাণ পানি উঠানো হয় তা রিচার্জ না হওয়া প্রকল্প অনেকটা গতি হারিয়েছে। এখন হস্তচালিত নলকূপ দূরে থাক অগভীর নলকূপে পানি ওঠে না। অনেক স্থানে গভীর নলকূপ পর্যন্ত বন্ধ করতে হচ্ছে। পদ্মাসহ শাখা নদী মরে যাবার কারণে ভূগর্ভস্থ যে পানি উত্তোলন করা হয় তা আর রিচার্জ হচ্ছে না। পদ্মা নদী কেন্দ্রীক আরেকটি সেচ প্রকল্প জিকে প্রজেক্ট তার গতি হারিয়েছে।
কুষ্টিয়া, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে কুষ্টিয়ায় পদ্মা-গড়াইসহ পাঁচ নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানি না পেয়ে শুকিয়ে গেছে পদ্মাসহ এর চারটি শাখা নদী। বন্ধ হয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। জিকের প্রধান ক্যানেলে পানি না থাকায় ভেড়ামারার ৩ নং ব্রীজ সংলগ্ন ক্যানেলে স্থানীরা ক্রিকেট খেলার আয়োজন করেছে। জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ থাকায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলার প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। চাষীরা যেমন দিশেহারা তেমন এ এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংসের সম্মুখীন। জিকে খালে পানি না থাকা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া জেলায় ১ লাখেরও অধিক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সু-পেয় পানির অভাবে মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
পদ্মায় পানি না থাকায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েক দফা গড়াই নদী খনন করা হলেও তেমন কোনও সুফল আসেনি। বর্ষা গেলেই চরের বালি আবার নদীতে নেমে গিয়ে ভরাট হচ্ছে নদী। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রুগ্ন পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়সহ গড়াই নদীতে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এসব চরে কৃষকরা ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন।
ফারাক্কা চুক্তি : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে মরুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০ বছরের পানি চুক্তি হয়। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবে গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হায়দ্রাবাদ হাউজে ঐতিহাসিক ৩০ বছরের পানিচুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা। কিন্তু কখনোই বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি। বরং বন্যার সময় ভারত ফারাক্কা গেইট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে পানিতে ভাসিয়েছে। আর শুস্ক মৌসুমে পানি না দেয়ায় বাংলাদেশের পূর্ব-মশ্চিমাঞ্চলের বিস্তুীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। সে সময় তিস্তা চুক্তি প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুক্তি করতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধার কারণে। মমতার বক্তব্য তিস্তা চুক্তি করা হবে না পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে। ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঘুরে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরও নিজের অবস্থান থেকে একচুলও সরেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার সাফ কথা, তিস্তায় পানি নেই। বাংলাদেশকে দেব কোথা থেকে?
মোদীকে মমতার চিঠি : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি মোদিকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি পানি নিয়ে আপস করবেন না।
চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই চিঠি লিখছি। জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পরামর্শ ও মতামত ছাড়া এ ধরনের একতরফা আলোচনা গ্রহণযোগ্য বা কাম্য নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি, যা ছিটমহল নামেও পরিচিত, ইন্দো-বাংলাদেশ রেলওয়ে লাইন এবং বাস পরিসেবাগুলো এই অঞ্চলে অর্থনীতির উন্নতির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার কয়েকটি মাইলফলক। তবে পানি খুবই মূল্যবান এবং মানুষের জীবন রক্ষা করে। আমরা এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আপস করতে পারি না, যা জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ধরনের চুক্তির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি বুঝতে পেরেছি ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ ফারাক্কা চুক্তি ফের নবায়ন করবে ভারত সরকার। চুক্তিটির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টনের নীতিগুলোর উল্লেখ আছে। আপনি জানেন, পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জন্য ও তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পানির প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।
মমতা চিঠিতে আরো লেখেন, ফারাক্কা ব্যারেজের মধ্য দিয়ে যে পানি সরানো হয়, তা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমি আপনার নজরে আনতে চাই, বহু বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে নদীর রূপতত্ত্ব পরিবর্তিত হয়েছে; যার ফলে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হচ্ছে এবং রাজ্যে পানির প্রাপ্যতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। গত ২০০ বছরে গঙ্গার পূর্বমুখী প্রবণতা বেশ কয়েকটি নদীর সঙ্গে সংযোগ বিঘিœত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জলঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা নদী পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বেড়েছে। তিনি আরো লিখেছেন, ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্মাণের সূচনা হলো গঙ্গা থেকে ভাগিরথীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে, কলকাতা বন্দরের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য কমপক্ষে ৪০০০ কিউসেক পানি সরবরাহ করার জন্য একটি ফিডার খাল তৈরি করা হয়েছে। এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, হুগলিতে পলি প্রবাহও ব্যারেজ তৈরির পর কয়েক বছর ধরে কমে গেছে। এর ফলে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েছে এবং ব্যারেজের উজানে এবং ভাটির দিকের এলাকাগুলো অতীতে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুৎ লাইনের মতো সরকারি অবকাঠামোসহ জীবন ও সম্পদের মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের আবাসস্থল থেকে তাদের গৃহহীন করা এবং তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। হুগলিতে পলির ভার কমে যাওয়ায় সুন্দরবন ব-দ্বীপের শক্ত অবস্থান বিঘিœত হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে, ব্যারেজ নির্মাণের পরে নদীর রূপচর্চার সম্ভাব্য পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী দেবী গৌড়া একটি চিঠি লিখেছিলেন যাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রদান করা হবে। রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূলধন ড্রেজিং। যদিও সেই অ্যাকাউন্টে ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনো তহবিল পাওয়া যায়নি।
২০০৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ প্রজেক্ট, অথরিটি (এফবিপিএ) এর এখতিয়ার ১২০ কিমি (ডাউনস্ট্রিমে ৮০ কিমি এবং উজানে ৪০ কিমি) পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছিল, যাতে এ অঞ্চলে এফবিপিএ দ্বারা প্রয়োজনীয় ক্ষয় রোধ করা যায়। এফবিপিএ এই প্রসারণের জন্য ক্ষয়রোধী কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে একতরফাভাবে ১২০ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১৯.৪ কিলোমিটার করা হয়েছিল, যা ধুলিয়ান এবং সমশেরগঞ্জের মতো শহরগুলোসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে বাদ দিয়েছিল। এটি এলাকার ভাঙনবিরোধী কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমি ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিলের মিটিংসহ বেশকয়েকটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। এ বিষয়ে, আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কয়েকবার লিখেছি। বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তিস্তা নদীর স্বাস্থ্য সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সিরিজ নির্মাণ, উচ্চ জলাভূমিতে বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মমতা লেখেন, শোনা যাচ্ছে, বৈঠকে ভারত সরকার বাংলাদেশে তিস্তা পুনরুদ্ধারের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। আমি অবাক হয়েছি যে, জলশক্তি মন্ত্রী ভারতে নদীটিকে তার আসল রূপ এবং স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। উল্লিখিত কারণে তিস্তায় পানির প্রবাহ বছরের পর বছর ধরে কমে গেছে এবং অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশের সাথে কোনো পানি ভাগ করা হলে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ সেচের পানির অপর্যাপ্ত প্রাপ্যতার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতেও তিস্তার পানির প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন করা সম্ভব নয়। পরিশেষে, আমার দৃঢ় সংকল্প জানাচ্ছি যে, তিস্তার পানি বণ্টন এবং ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনাই রাজ্য সরকারের সম্পৃক্ততা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে করা উচিত নয়। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থ সর্বাগ্রে, যার সঙ্গে কোনো মূল্যে আপস করা উচিত নয়। আমি আশা করি, আপনি পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রত্যাশাকে উপলব্ধি করবেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
রেলওয়ে কানেক্টিভিটি : ভারতের সঙ্গে ১০ দফা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের একটির নাম দেখা হয়েছে রেলওয়ে কানেক্টিভিটি। এটা মূলত ভারত বাংলাদেশের সাথে রেল করিডোর করার সিদ্ধান্ত। শিলিগুড়ি করিডোর দুটি স্থল ও রেলবেষ্টিত করিডোর। এই করিডোরের সড়কপথ মাঝেমধ্যেই ভূমিধ্বস, বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায়ই বিঘিœত হয়। আবার যে রেলপথ আছে, সেটাও সিঙ্গেল গেজ তথা এক লাইন বিশিষ্ট। শিলিগুড়ি করিডোরের অনেকটা বিকল্পস্বরূপই এই বাংলাদেশ-ভারত রেল করিডোর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই করিডোর ভারতের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। এই করিডোর ভারতের যোগাযোগ আরো সহজ করবে। যেমন- আগে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে কলকাতা থেকে মনিপুর-নাগাল্যান্ড যেতে সময় লাগতো ৩২ ঘণ্টা। এখন বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে কলকাতা থেকে মেঘালয় হয়ে মনিপুর-নাগাল্যান্ড যেতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। ২৮ ঘণ্টা সেইফ। এখানেও ভারতের লাভ ১০০ তে ১০০।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের লাভ কি? ভারতের সাথে যোগাযোগ সহজ হবে, সহজেই ভারত থেকে চিকিৎসা সেবা নেয়া যাবে। বাংলাদেশ কিছু আ্যডভান্টেজ পেলেও ভারতের বেনিফিট বরাবরের মতই অনেক বেশি। আর বাংলাদেশের ক্ষতি কি? ভারত সবসময় বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বকে খর্ব করতে পারে এই করিডোর। ভারত করিডোর ব্যবহার করে শুধুমাত্র পণ্য পরিবহনই করেব না, সমরাস্ত্রও পরিবহণ করবে। দিনশেষে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষের উপর। এই সমরাস্ত্র ফেলানীদের হত্যা করে, কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এই করিডোর তৈরির অনুমতি দেয়া, খাল কেটে কুমির আনা।
বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থা যেন এন্ড্রু কিশোরের গানের মতো ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু/ভালোবাসা পেলাম না/আশায় আশায় দিন যে গেলো/আশা পূরণ হলো না’। বাংলাদেশ শুধু ভারতকে দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আশা পূরণ হচ্ছে না।ইনকিলাব