পুলিশ কর্মকর্তার মা–বাবাকে কুপিয়ে হত্যা, বাড়িজুড়ে রক্তের দাগ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪
  • ৮১ দেখা হয়েছে

* নির্মাণাধীন ভবন দিয়ে ভেতরে ঢোকে খুনিরা
* নিচতলা থেকে চারতলার ছাদ পর্যন্ত রক্তের দাগ
* ছাদ দিয়ে পালিয়ে যায় খুনিরা

ডেস্ক রির্পোট:- চারতলা বাড়ির নিচতলায় মূল গেটের ভেতরের সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সেখান থেকে অদূরেই গ্যারেজের কোনা পর্যন্ত রক্তাক্ত দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার মোটা চিহ্ন। চিহ্ন যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল শফিকুর রহমানের রক্তভেজা মরদেহ। তাঁর ঘাড়, গলা, মুখ ও কানের নিচে ভারী ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষত। ডান হাটের বুড়ো আঙুল বিচ্ছিন্ন। দেহ থেকে নির্গত রক্ত প্রায় এক হাত জায়গাজুড়ে জমাট বেঁধে আছে। এই কোনা থেকে ডান পাশে ভেতর বাড়ির কলাপসিবল গেট, সেই গেট ধরে চারতলার ছাদ পর্যন্ত সিঁড়ি।

নিচতলার গ্যারেজ থেকে রক্তভেজা পায়ের ছাপ ও ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ ধরে দোতলায় গিয়ে দেখা যায়, নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা নারীর মরদেহ। দোতলায় হাতের ডান পাশের ফ্ল্যাটের বাঁ পাশের কোনায় শয়নকক্ষে বিছানার ওপর দেখা যায় নিথর এই দেহ। তাঁর মাথা, মুখ, কপাল ও গালে ছয়টি গভীর কোপের দাগ। বিছানার চাঁদর এক কোনায় ঘোঁচ হয়ে আছে, জানালা ঘেঁষা তোশকের ওপর দলা দলা জমাটবাঁধা রক্ত। ঘরের ভেতর খুন হওয়া এই নারী শফিকুর রহমানের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোমেনবাগ বটতলা এলাকায় বৃহস্পতিবার ভোরে বাড়িতে ঢুকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়। এই দম্পতির এক সন্তান মো. ইমন পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) উপপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। ঈদের ছুটিতে তিনি গতকালই (বুধবার) ঢাকার বাড়ি থেকে বাইরে যান। আর এক মেয়ে ইবু, থাকেন শ্বশুরবাড়িতে। এই হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। পুলিশের ধারণা দীর্ঘ সময় পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এটি হতে পারে বলে ধারণা পুলিশ ও স্বজনদের।

আজ মোমেনবাগের আড়াবাড়ি বটতলার ওই বাড়িতে কথা হয় নিহত দম্পতির ছেলে মো. ইমনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ভোরে আমার মা–বাবাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাঁরা আমাদের খুবই পরিচিত। কিন্তু কারা এটি ঘটিয়েছে জানি না। আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনির দাগনভূঞার জমি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে ঝামেলা আছে। সে কারণেও হতে পারে।’

এই ঘটনা কোনো ডাকাতি বা চুরির জন্য হয়নি বলে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জমিসংক্রান্ত বিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক তদন্ত শুরু করা হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানা গেছে।

এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘তাঁদের পারিবারিক জমিসংক্রান্ত বিরোধকে আমরা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছি। তবে এটা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যায় না। যাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁদের একজন দেশের বাইরে থাকেন।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ডাকাতি বা চুরির ঘটনা বলা যাচ্ছে না। কারণ, ওই নারীর গলায় স্বর্ণের চেইন ও মোবাইল ফোন অক্ষত খোয়া যায়নি। তবে বাসার ভেতর সব আলমারি খোলা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জমিসংক্রান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় সামনে রেখে আমাদের তদন্ত চলছে, তদন্ত কার্যক্রম শেষ হলে হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’

নিহত শফিকুর রহমান জনতা ব্যাংকের সাবেক গাড়িচালক। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ফেনীর দাগনভূঞায় জমিসংক্রান্ত বিরোধ চাচাতো ভাইয়ের ছেলেদের। তাঁর নামে ওই জমি বিরোধের চারটি মামলা করেছে চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী নূর জাহান। মামলাগুলোর মধ্যে দুটি খারিজ হয়ে গেছে আর দুটি মামলা চলমান।

এ বিষয়ে শফিকুর রহমানের আপন ভাই মফিজুর রহমান বলেন, ‘যাদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ তারা আমাদের শরিক ও ভাগীদার হলেও খুবই দুষ্টপ্রকৃতির লোক। আমাদের চাচাতো ভাইয়ের এক ছেলে শফিকুর ভাইয়ের থেকে জোর করে কিছু জমি কিনতে চেয়েছে কয়েকবার কিন্তু ভাই সেটা দেয়নি। এটা নিয়েই একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়েছে তাঁরা।’

পাশের নির্মাণাধীন ভবন দিয়ে ঢুকে ওত পেতে থাকে খুনিরা
শফিকুর রহমানের বাড়ির ডান পাশেই একটি সাততলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। তাঁর মরদেহ গ্যারেজের যে পাশে পড়ে ছিল সেই পাশ ঘেঁষেই নির্মাণ করা হচ্ছে ভবনটি। নির্মাণাধীন এই ভবনের প্রথম তলায় উঠলে সহজেই শফিকুর রহমানের বাড়ির সীমানা প্রাচীর দিয়ে নিচ তলার গ্যারেজে নামা যায়। শফিকুর রহমান প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান এবং নামাজ শেষে এসে পানি তোলার জন্য মোটর ছাড়েন। আজ ভোরেও তিনি পার্শ্ববর্তী মসজিদে নামাজ আদায় করে বাড়ি ফেরেন এবং মোটর চালু করতে যান। মোটর চালু করার সময় তাঁকে পেছন থেকে আঘাত করে খুনিরা। সে সময় তাঁর হাতে ও ঘাড়ে কোপ লাগে। এরপর শব্দ হলে তাঁকে সেখান থেকে টেনে গ্যারেজের কোনায় নিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা যাত্রাবাড়ী থানার এক উপপরিদর্শক বলেন, ধারণা করা যায় নির্মাণাধীন এই ভবন দিয়ে ভেতরে ঢোকে খুনিরা। তারপর শফিক সাহেব নামাজ থেকে আসার সময় পর্যন্ত ওত পেতে থাকেন।

নিচতলার ভাড়াটেদের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল
খুনিরা যখন থেকে নিচতলায় অবস্থান করছিল তখন থেকেই নিচতলার ফ্ল্যাটের মূল দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে প্রথম দিকে যারা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন তাঁদের একজন শফিকুর রহমানের স্বজন ও প্রতিবেশী রাফিউর রহমান তালহা। তিনি বলেন, ‘আমি এসে গ্যারেজের কোনায় লাশ পরে থাকতে দেখেছি। তাঁর ঘাড় ও গলায় অনেক কোপ ছিল। নিচতলার ভাড়াটিয়াদের ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল। কোনো ভাড়াটিয়াই এই ঘটনার কিছু বুঝতেও পারেনি।’

ছাদ দিয়ে বের হয়ে পাশের নির্মাণাধীন ভবন দিয়ে বের হয় খুনিরা
দোতলায় দ্বিতীয় খুন সম্পন্ন করে খুনিরা তিন ও চার তলা বেয়ে বাড়ির ছাদের গেট দিয়ে বের হয়ে পাশের নির্মাণাধীন ভবন দিয়ে নিরাপদে নিচে নেমে যায়। দোতলার ঘটনাস্থলের বাইরের দরজার সামনে একটি চাবি পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া একই ভাবে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় সিঁড়িতে, তিন তলার বামপাশের ফ্ল্যাটের দরজার চৌকাঠে এবং সিঁড়ি ঘেঁষা ডানপাশের দেওয়ালে। রক্তের দাগ দেখা যায়, ছাদের দরজার শিকল ও কাঠে। ছাদের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে খুনিরা ডান কার্নিশ পেরিয়ে ডান পাশের নির্মাণাধীন ভবনে যায়। কার্নিশ পেরিয়ে পাশের ভবনে যাওয়ার সময় খুনিদের হাতের রক্ত ছাপ লেগে থাকতে দেখা গেছে সেই ভবনের বিমে।

মামলার ছায়া তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরো ঘটনাটিতে অংশ নিয়েছে তিন থেকে চারজন। খুবই ঠান্ডা মাথায় তারা সময় নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। খুনিরা এই বাড়ির সবকিছু জানে ও চেনে। তারা নিচতলা দিয়ে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় দুটো খুন করে ছাদ দিয়ে বের হয়ে গেছে। মার্ডারের ধরন দেখে আমরা ধারণা করছি খুনি ও ভুক্তভোগী একে অপরকে খুব ভালোভাবে চেনে।’আজকের পত্রিকা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions