ডেস্ক রির্পোট:- চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে ২৬টি পাহাড়। এসব পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অন্তত ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার। পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস না করা, পাহাড় কর্তন না করা, পাহাড়ের ক্ষতি না করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়। লাগানো হয় সাইনবোর্ডও। কিন্তু সেগুলোতে কেউ কর্ণপাত করে না। ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা এলাকার পরিমাণ ছিল ৬৭৯ হেক্টর। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৫ হেক্টরে। প্রতি বছর যে হারে পাহাড় নিধন চলছে, তাতে নগরীতে পাহাড় কাটা এলাকা বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার হেক্টর হয়েছে বলে ধারণা গবেষণা সংশ্লিষ্টদের। পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ নামে একটি গবেষণায় গুগল আর্থের ছবি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শুধু তা-ই নয়, এসব অবৈধ পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন, তারা বৈধভাবেই ভোগ করছেন পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সুযোগ-সুবিধা। তবে প্রতিবারের মতো এবারও ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ধসের অগ্রিম আবহাওয়া বার্তা শুনে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কোন কোন পাহাড়ে কারা কারা অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করছেন, তাদের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বিভাগীয় কমিশনার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গত বুধবার থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে ভারি থেকে অতি ভারিবর্ষণের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি পাহাড়ধস বা ভূমিধসের শঙ্কার কথাও বলা হয়েছে। এ কারণে পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসতে মাইকিং করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছরই চট্টগ্রামে বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই শুরু হয় পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কাজ। পরিচালিত হয় উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু দুর্যোগ শেষ হলেই সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়। মানুষ ফের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতেই বসবাস শুরু করে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে খুঁটি স্থাপন করেই নেওয়া হয় বিদ্যুতের লাইন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়িত হয় না।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, নগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থ বা বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি। শুধু চট্টগ্রাম রেলওয়ের জায়গায় অবৈধভাবে বসবাস করা পরিবারগুলোতেই রয়েছে ৫ হাজার ৩০০ অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন। কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে বন্দোবস্ত না দেয়, তাহলে সেখানকার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হবে। বর্তমানে আবহাওয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। রয়েছে ভারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পাহাড়ধসের শঙ্কা। তাই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা পরিবারগুলোকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র সরিয়ে আনতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। আমরা চাই প্রত্যেকে নিরাপদে থাকুক।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ২৬টি পাহাড়ে সাইনবোর্ড রয়েছে। পরিবেশ আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশে মানতে বলা হয়েছে। গত এক বছরে অনেক খাসজমি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে আগে অবৈধ বসবাস ছিল। বুধবার থেকেই চট্টগ্রাম নগর ও উপজেলাগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নগরীতে গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে উচ্ছেদ করা হয়েছে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ৫১টি পরিবারকে।
এই পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা কতজনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব অসহায়দের সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম বিভাগের ৩ হাজার ৫০০ বেশি মানুষকে আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া হয়েছে।
কোন পাহাড়ে কত বসবাস: চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। সেখানে থাকেন প্রায় ৪ হাজার ৪৭৬ পরিবার। এ ছাড়া নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালীহিল পাহাড়ে বসবাস ৪৩১ পরিবারের। এ ছাড়া কৈবল্যাধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে ১৪৬ পরিবার, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ ১২ পরিবার, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচ পরিবার, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪ পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬ পরিবার, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮ পরিবার, আমিন জুট মিলস কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ৬৫ পরিবার, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮ পরিবার, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২ পরিবার, আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার বসবাস করছে।
লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩ পরিবার, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪ পরিবার, নাছিয়াঘোনা এলাকায় ১২ পরিবার, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯ পরিবার, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচ পরিবার, নাগিন পাহাড়ে ২৫ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮ পরিবার, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অক্সিজেন) ১১ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
থেমে নেই পাহাড় কাটা: পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ নামের একটি গবেষণায় গুগল আর্থের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা এলাকার পরিমাণ ছিল ৬৭৯ হেক্টর। আর ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৫ হেক্টরে। প্রতি বছর যে হারে পাহাড় নিধন চলছে, তাতে নগরীতে পাহাড় কাটা এলাকা বেড়ে এখন ২ হাজার হেক্টর হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ২০১২ সালের পর আর গবেষণা হয়নি। তাই পাহাড় কাটা এলাকার প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি।
গত এক বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামে মামলা করেছে ১২টি। তার আগের বছর মামলা হয় ২২টি। ২০ বছরে মামলা হয়েছে শতাধিক। আবার অধিদপ্তরের অগোচরে রয়ে যায় অনেক পাহাড় কাটার ঘটনা। বায়েজিদ ও আকবরশাহ এলাকায় বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটছে। প্রায় ৮০ শতাংশ মামলা হয়েছে এ দুটি এলাকায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেলেই অভিযান চালানো হয়। প্রতি মাসেই মামলা করা হয়। পাহাড় কাটার সঙ্গে বিভিন্ন পেশার মানুষ জড়িত। এটি বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
এদিকে আবাসন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পেটেও ঢুকছে চট্টগ্রামের পাহাড়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ বছরে শহরের সবচেয়ে বেশি পাহাড় নিধন হয়েছে বায়েজিদ থানা ও পাহাড়তলী বা আকবরশাহ এলাকায়। এখনো এই দুই এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। আকবর শাহ এলাকায় বর্তমানে পাহাড় কাটার মূল হোতা আওয়ামী লীগের নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল হক ওরফে জসিম। পাহাড় কাটার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া বায়েজিদ থানা এলাকার রৌফাবাদ, অক্সিজেন, ষোলশহর, আরেফিন নগর, নাসিরাবাদ, পলিটেকনিক, কূলগাঁও, জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। এখানে পাহাড় কাটার পেছনে বায়েজিদের জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহার উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুদ্দিনসহ কয়েকজনের নাম এসেছে। এই দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া বায়েজিদ থানার নাগিন পাহাড় ফের কাটার অভিযোগে বাহার উদ্দিন, শামসুদ্দিনসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতো মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে বসবাস: প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ হয় মৃত্যুর মিছিল। তার পরও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। গত ১৩ বছরে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এখানে বসবাস করছেন। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।
ছলিমপুর পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী ডেইজি দাশ বলেন, মনিকা রানী নামে একজনকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে এখানে বসবাস শুরু করি। প্রশাসন একবার উচ্ছেদও করে। পরে আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। সরকার যদি আমাদের পুনর্বাসন করে, তাহলে সেখানে চলে যাব।
জোছনা বেগম নামে আরেকজন বলেন, বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। তাই ঝুঁকি জেনেও এখানে থাকি।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে এক দিনেই পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ মারা যায় ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ধসে মৃত্যু হয় চার পরিবারের ১২ জনের। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যান ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুনে মারা যায় ২৪ জন। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে মারা যায় দুজন। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে মারা যায় তিনজন, একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে মারা যায় চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় মৃত্যু হয় এক শিশুর। ২০২২ সালের ১৮ জুন মৃত্যু হয় চারজনেরকোলবেলা