ডেস্ক রির্পোট:- সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধের পর গতকাল সোমবার দেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের পর আর কখনো রিজার্ভ এত নিচে নামেনি। আবার এই রিজার্ভের পুরোটাই ব্যয়যোগ্য নয়। নিয়ম অনুযায়ী চলতি দায় বাবদ আকু বিল, বৈদেশিক পাওনা, প্রকল্প বকেয়া বিল এবং বিশেষ পরিপূরক মুদ্রার (এসডিআর) বকেয়া হিসাব বাদ দিয়ে গতকাল নিট বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ১৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় রিজার্ভের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ কমে গেলেও বিপিএম-৬ অনুযায়ী এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে যায়নি। তবে আড়াই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমতে থাকায় দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।
রিজার্ভের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে বৈদেশিক বাণিজ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবশ্য আগামী জুনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হলে রিজার্ভ অনেকটাই শক্তিশালী হবে।
তথ্য বলছে, গত তিন মাসে (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ) গড় আমদানি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, ৫ দশমিক ২০ বিলিয়ন ও ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। গড় হিসাবে মাসে তা ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে দেশের প্রয়োজন হবে ১৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো দেশের রির্জাভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে নিচে নেমে গেলে বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়তে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের কনফারমেশন চার্জ বেড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও বাণিজ্য সীমা (লিমিট) কমিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি বিদেশি ব্যাংকগুলোর কনফারমেশন চার্জ বেশি হওয়ার পরও এলসি খুলতে অনিহা দেখায়। আবার রিজার্ভ যদি ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন কনফারমেশন চার্জ কমে। ওই অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে কনফারমেশন ছাড়াও এলসি খোলে বিদেশি ব্যাংক।
এ বিষয়ে মধুমতি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ‘কোন দেশের রিজার্ভ যখন ভালো অবস্থানে থাকে বা ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন এলসি খুলতে গেলে কনফারমেশন চার্জ কম লাগে এবং কোনো কোনো সময় কনফারমেশন ছাড়াই এলসি খোলা যায়। কিন্তু রিজার্ভ যখন নিম্নমুখী থাকে, তখন কনফারমেশন চার্জ বাড়ে। আমদানি খরচও বাড়ে। এতে পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব তৈরি হয়। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ যে অবস্থানে রয়েছে সেটি খুব বেশি খারাপ নয়। তবে আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। রিজার্ভ এখন ২৫ বিলিয়নের বেশি থাকা দরকার ছিল।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক (গ্রস) হিসাবে দেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২২ দশমিক ৩ বিলয়ন ডলার। এরপর থেকে রিজার্ভে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন, ২০১৬ সালে ৩২ দশমিক ১ বিলিয়ন এবং ২০১৭ সালে ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কিছুটা কমে আবারও ৩২ বিলিয়ন ডলারে নামে। এরপর আরও উর্ধ্বমুখী ছিল রিজার্ভ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় রিজার্ভ। তবে এরপর থেকেই রিজার্ভ কমতে থাকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছিল ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। আর সার্বিক হিসাবে গতকাল সোমবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
তথ্য বলছে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে ডলার বিক্রি, আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়া এবং বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের হার বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। আর সরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও রয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলারের দর নির্ধারণ করে দিত বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ডলার বাজারের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ডলারের একক দর নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) হাতে। তবে দেড় বছর এই পদ্ধতি চালু থাকলেও ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়নি। এ কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত ও ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত বৃহস্পতিবার ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলারের দাম এক ধাপেই ৭ টাকা বেড়ে হয়েছে ১১৭ টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে—তা নিয়ে সন্দিহান অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ক্রলিং পেগের নামে নতুন যে পদ্ধতি চালু হলো সেটা আসলেই ক্রলিং পেগ কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। আইএমএফ কেন এটাকে ক্রলিং পেগ হিসেবে মেনে নিল, তা বোধগম্য নয়। কেননা এখানে ক্রলিং করার কোনো উপায় বলা নেই। এ পদ্ধতি বাজার পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে উল্টো ডলারের জোগান কমিয়ে দেয় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুদের হার বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ ব্যাংক যেই সুবিধা পেতে, তা নষ্ট করে দিতে পারে বিনিময় হারের এই ধরে রাখার নীতি। এতে মূল্যস্ফীতি কমার পরিবর্তে বেড়ে যেতে পারে।’
পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী মনজুরুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব নীতি ইতোপূর্বে নিয়েছে সেগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এজন্য নতুন করে সুদ হার নির্ধারণ ও মুদ্রা বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ ঘোষণা করা হয়েছে। এই নীতি কতটুকু সফল হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ফল মূল্যায়নের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’কালবেলা