আবু হানিফ:- মে দিবস। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। সেখানে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করে, এতে নিহত হন অনেকেই। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবসে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাদের নিয়ে এই দিবস তারা এই সম্পর্কে কতটা অবগত? তাদের অনেকেই জীবনের তাগিদে এই দিনেও কাজ করেন। তারা জানেই না মে দিবস কী।
১৮৮৬ থেকে ২০২৪। শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসংগত কার্য সময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৮ বছর। গত ১৩৮ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার।
কিন্তু এই প্রশ্নের আজও উত্তর খুঁজতে হয়, এতো উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হলেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? বিশ্বে আবিষ্কার হয়েছে উন্নত সব প্রযুক্তির, তারপরও শ্রম ছাড়া কোনো কিছুই উৎপাদন করা যায় না- এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থা বিদ্যমান নেই যার মাধ্যমে একজন কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর তার নিয়োগ দাতার কাছে নিজের অধিকার বা নিয়মের বিষয়ে কিছু বলতে পারে। এই শ্রমিকেরাই অনেক কঠিন কঠিন কাজ করছে। বড় বড় ফ্লাইওভার নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, কৃষি কাজ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তারাই বেশি অবদান রাখছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে নেই তেমন কাজের পরিবেশ। অথচ তাদের শ্রমের ফলে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু এই শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। দেশের গার্মেন্টস শিল্পে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা, রানা প্লাজা ধস।
গত ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১১ বছর পূর্ণ হয়। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল ৯ তলা ভবনটি। ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঘটনায় এখনও বিচার হয়নি কারও। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ এখনো কর্মহীন আছেন। তাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ গত ৫-৮ বছর ধরে কর্মহীন। আর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ গত ৩-৪ বছর ধরে কর্মহীন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) পরিচালিত এক সমীক্ষা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
৮ ঘন্টার কর্ম দিবসের দাবি কোথাও কোথাও পূরণ ও কর্ম পরিবেশ কিছুটা উন্নত হলেও আজ শ্রমিকদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো অর্জিত হয়নি। করোনা মহামারিতে আবারও স্পষ্ট হয়েছিলো, এ দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো কতটা ভঙ্গুর। তৈরি পোশাক শিল্পের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেতনের দাবিতে সমবেত হচ্ছে, বিক্ষোভ করছে।সেখানেও মালিক পক্ষের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নামলে সেখানেও পুলির লাঠিপেটা ও আটক করে। যাদের শ্রম আর ঘামে সচল দেশের অর্থনীতির চাকা, তারাই বঞ্চিত তাদের অধিকার থেকে। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত ও নিপীড়িত আর নারীদের জন্য মোকাবিলা করতে হয় নানান প্রতিবন্ধকতা ।
বাংলাদেশে হোটেল শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়৷ কিন্তু তাদের জীবন মান খুবই নিম্নমানের। হোটেল শিল্পে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শ্রম মানদণ্ডসহ বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা-২০১৫ কার্যকর করার ক্ষেত্রে এ শিল্পের মালিকরা দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। শ্রম আইনে নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক থাকলেও এ শিল্পের সাথে সম্পর্কিত প্রায় ৩০-৩৫ লাখ কর্মরত শ্রমিককে তা প্রদান না করেই বছরের পর বছর কাজ করানো হচ্ছে। শ্রম আইনে উল্লেখিত নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, অতিরিক্ত কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরি, সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি এবং উৎসব বোনাসসহ আইনস্বীকৃত কোনো অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় না।
মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে বছর দুয়েক আগে বিশ্বের সাথে সাথে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে বাংলাদেশও একটি। তবে পাকিস্তান ছাড়া এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে কমেনি। ফলে এই সময়টাতে শ্রমিকদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে অসংখ্য শ্রমিক। এমনকি কর্পোরেট অফিসগুলোতে ছাঁটাই করা হয়েছিলো, ঠিকমতো দেয়া হয়নি বেতন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে না কর্মসংস্থান, ফলে বাড়ছে বেকার সংখ্যা।
মহান মে দিবসে সকল খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি রইলো সম্মান আর ভালোবাসা। শ্রমিকরা ফিরে পাক তাদের ন্যায্য অধিকার, বন্ধ হোক সকল বৈষম্য ও শ্রমিক নির্যাতন এমনটাই প্রত্যাশা আজকের দিনে।
(উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক
গণঅধিকার পরিষদ)