ডেস্ক রির্পোট:-চৈত্রের পর বৈশাখের প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে দেশ। টানা প্রায় এক মাস যাবত তীব্র গরম, খরা-অনাবৃষ্টি, শুষ্ক বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) ও বিদেশী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস বলছে, এ বছর উচ্চতাপ ও খরা পরিস্থিতি দীর্ঘয়িত হতে পারে। এমনিতেই উজানে ভারতের নিয়ন্ত্রণ পানি আগ্রাসনের কারণে সব নদনদী শুকিয়ে গেছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রক্ষèপুত্র নদের চারপাশে ধূধূ বালুচর। বৈশাখ জুড়ে চলছে তীব্র তাপদাহ। এমনকি আসছে জ্যৈষ্ঠ মাসেও রেকর্ড ছাড়ানো উচ্চ তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টি-খরা পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে। দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টি-খরায় পানির সঙ্কটে হাহাকার পড়ে গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট তীব্র। দুঃসহ জীবনধারণ। পানির সন্ধানে ছুটছে মানুষ দূর-দূরান্তে। দূষিত পানি পান করে নানাবিধ রোগব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকেই। সেই সাথে খাল-ছরা, পাহাড়ি ঝিরি-ঝররণা পানিশূন্য। তাপদাহে বাতাসে যেন আগুনের হলকা। গরম বাতাসের তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে আম,কাঁঠাল, লিচু, জামের গুটি, পোক্ত হওয়ার আগেই সেগুলো অকালে শুকিয়ে ঝরে পড়ছে ঝরা বকুলের মত। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। হিটস্টোকে সারাদেশে ইতোমধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরাও নিদারুণ কষ্টে একেকটি উত্তপ্ত দিন পার করছে।
সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটির নিচ থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কোথাও কোথাও ১১০ থেকে ১২০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক এলাকাতেই হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ফলে এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে। পরিবারের খাবার পানি সংগ্রহের জন্য দুই তিল কিলোমিটার দূরে কলসি নিয়ে ছুটে যেতে হচ্ছে। তারপরও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। খাবার পানির জন্য কারবালার মত হাহাকার করছে ওইসব এলাকার মানুষ। পানির অভাবে পশু-পাখির জীবনও ওষ্ঠাগত। ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। প্রকৃতি বিরান মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি কার্যক্রমও। বিভিন্ন ফসলি নির্ভর এলাকার কৃষি কাজ ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষক চাষাবাদি জমিতে পর্যাপ্ত পানি উত্তোলণ করতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। একই সাথে প্রতিটা বাড়ির টিউবয়েল গুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। সামান্য একগ্লাস পানিও মিলছেনা টিউবয়েল থেকে।
দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা, এবং পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। মরন বাঁধ ফারাক্কার ছোবলে শুকনো মৌসুমের আগেই দেশের নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া এবং গত কয়েক বছর যাবৎ বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। আগামীতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলেও তারা মনে করেন।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, সেচ এবং নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য কাজে প্রতিদিনই মাত্রাতিরিক্ত পানি মাটির নিচ থেকে তোলা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত বছর জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে যা গত ৪৬ বছরের মধ্যে আর হয়নি। কমবৃষ্টিপাত এবং মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভের পানি স্তর রিচার্জ হচ্ছে না। এতে প্রকৃতিতে মরুকরণ প্রক্রিয়া তরান্বিত হচ্ছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য নতুন পুকুর খনন ও বিদ্যমান পুকুরগুলোর পুন:খনন, কম পানি লাগে এমন ফসলের চাষ এবং ভূগর্ভস্থ পানির কৃত্রিম রিচার্জে জোর দিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। সরকারকে অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ সঙ্কট পুরো দেশকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাবে।
সম্প্রতি ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক গবেষণা করেছে। গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং চলতি বছরের জুন মাসে ওয়ারপোর অনুমোদন পায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। পানি সংকটাপন্ন এলাকা বাড়ছে। গবেষণার তথ্যমতে, এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ৬ ও নাচোলের চার ইউনিয়নে। নওগাঁর কয়েকটি স্থানে ১৫০০ ফুট মাটির নিচেও মেলেনি ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর।
তীব্র দাবদাহ এবং সারাদেশে পানির সঙ্কট নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো।
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে বর্ষাকাল শেষ না হতেই। এখন আরও দ্রুতই নিচের দিকে নামছে। হাজার হাজার শ্যালো ও গভীর নলকূপ অকেজো। পানি উঠছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে পানির স্তর বা লেয়ার গত ১০ বছরে স্থানভেদে ৫০ ফুট থেকে ২৮০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এমনিতেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের উঁচু-নিচু, ঢালু, পাহাড়-টিলাময় ও উপকূলীয় ভূমির মিশ্র এবং ব্যতিক্রম বৈচিত্র্য রয়েছে। তদুপরি উচ্চ তাপদাহ খরা-অনাবৃষ্টির কারণে নদ-নদী-খাল-ছরা-হ্রদ, পুকুর-দীঘি-কূয়াসহ পানির উৎসগুলো অতি দ্রুত শুকিয়ে গেছে। সুবিশাল কাপ্তাই তথা কর্ণফুলী নদীর হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে হাজার হাজার হেক্টর উঁচুনিচু জমি অনাবাদী পড়ে আছে।
অন্যদিকে উপকূল অতিক্রম করে সাগরের লোনা পানির আগ্রাসন উজানের দিকে বিস্তৃত হয়েছে। এতে করে খাবার পানি লোনায় আক্রান্ত এবং ফল-ফসলি বিস্তর জমি লোনা কবলিত ও অনাবাদী হয়ে পড়ছে। গত দু’য়েক বছরেই সমুদ্রের লোনা পানি জোয়ারে হালদা নদী পর্যন্ত উঠে আসছে। লোনার কবলে দেশের একমাত্র মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষিত হালদার রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশসহ বিভিন্ন জাতের বড় মাছের বিচরণ, প্রজনন ও উৎপাদনশীলতা হুমকির মুখে। হালদা পাড়ে কৃষি-খামার সঙ্কটাপন্ন। তাছাড়া হালদা নদীর পানি থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার বড়সড় পানি উত্তোলন ও পরিশোধন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। লবণাক্ত হয়ে পড়েছে ওয়াসার পানি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানির সঙ্কট ফের বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আবহাওয়া-জলবায়ু, পানিসম্পাদ ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণ জানান, দেশে ক্রমবর্ধমান পানি সঙ্কটের মূলে রয়েছে ৫৪টি অভিন্ন প্রধান নদ-নদীসহ ছোট-বড় অনেকগুলো নদীর উৎসমুখে উজানে বাঁধ, ব্যারাজ নির্মাণসহ নানাবিধ কৌশলে ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণ। যা মোদ্দা কথায় পানি আগ্রাসন।
টানা উচ্চ তাপপ্রবাহ ও খরা-অনাবৃষ্টির কারণে সঙ্কটে পড়েছে জনজীবন এবং কৃষি-খামার অর্থনৈতিক খাত। দিনে-রাতে তীব্র খরতাপে পুড়ছে মাঠ-ঘাট-বিল। শুকিয়ে গেছে নদ-নদী-খাল। গ্রীষ্ম মৌসুমী ফল-ফলাদি, আধাপাকা ইরিবোরো ফসলে হিট শকের আশঙ্কায় চিন্তিত কৃষক। ইতোমধ্যে ফল-ফসল আধপোড়া, বিবর্ণ, খাক হয়ে গেছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে পানির সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানায় । দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পজোন ৩৫ হাজার একর আয়তনের চট্টগ্রামের মীরসরাই-সীতাকুণ্ড-সোনাগাজী বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চলেই মিলছে না চাহিদার তুলনায় ৩০ শতাংশ পানি। মাটির উপরের এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচের দিকে নেমে যাওয়ার পরিণামে ভূমিকম্প, ভূমিধসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি (বর্তমানে রুয়েট ভিসি) প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাহাড়-টিলা উঁচুনিচু উপকূলীয় ভূমি বৈচিত্র্যের গঠন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বা লেয়ার আশঙ্কাজনক হারে নিচের দিকে নামছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। ভরা বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত হচ্ছে কম। অন্যান্য সময়ে ও হঠাৎ ভারী বা মাঝারি বর্ষণ হচ্ছে সীমিত কোন এলাকায়। তাছাড়া চট্টগ্রামে হ্রদ, জলাশয়, দীঘি, খাল-ছরা, পুকুর, কূয়া ইত্যাদি মিলিয়ে পানির ব্যাপক উৎসগুলো ছিল সেগুলো কালক্রমে মানুষ ভরাট, দখল ও ধ্বংস করে ফেলছে। এ কারণে বর্ষায় মাটির উপরিভাগে পানি ধারণ বা স্টক হচ্ছে খুবই কম। আবার ভূগর্ভস্থ পানি সারা বছর নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে পানির সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে।
এ অবস্থায় ভূ-উপরিভাগে ব্যাপকহারে জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণ করতে হবে। নগরীতে যেসব খাল-নালা-ছরা রয়েছে সেগুলোর ময়লা-আবর্জনা-পলিথিন, জঞ্জাল পরিস্কার করে সুপেয় পানি চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচের দিকে নামলে ভূগর্ভের মাটিতে ফাঁকা বা গ্যাপ তৈরি হয়। এর ফলে মাটির উপরে-নিচের ভারসাম্যহানি হচ্ছে। যখন ভূমিকম্প কিংবা ভূমিধস হবে তখনই সেই গ্যাপের কারণে উপরের মাটি ধসে গিয়ে জনবসতিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মিত হলেও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে মাটির নিচে ফাঁকা বা খালি জায়গা তৈরি হওয়ায় সেসব ভবন বা স্থাপনা তখন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। এ অবস্থায় আমাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং মাটির উপরিভাগে জলাধার, খাল-হ্রদ সৃষ্টি ও সেই পানি যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. আয়েশা আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম মহানগরীর ২২টি ওয়ার্ডে সরেজমিনে গবেষণা চালিয়ে দেখেন, ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত নিম্নমুখী। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি বন্দরনগরীর কেন্দ্রস্থল পাঁচলাইশ এলাকায় একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের সময় পানির স্তর মিলেছে ৫শ’ ফুট নিচে।
বন্দরনগরীর বেশিরভাগ জায়গায় একশ’ থেকে ৩শ’ ফুট নিচে পানি মিলছে। অনেক জায়গায় ভূগর্ভে পানির স্তর পাওয়াই কঠিন। পাহাড়তলী ভূগর্ভে পানি সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাগরের উপকূলবর্তী চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সরল ও গণ্ডাামারা এলাকায় মিঠা পানির স্তর বা লেয়ার পাওয়া গেছে ৮শ’ থেকে ১২শ’ ফুট নিচে। আনোয়ারার পারকি সৈকতের আশপাশে নলকূপে উঠছে লবণাক্ত পানি। পটিয়ায় মিঠা পানির স্তর ৪০ থেকে ৮০ ফুট নিচে। অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচের দিকে যাওয়ার পাশাপাশি উপকূলের কাছে কিংবা অনতিদূরে মিঠাপানির স্তরকে গ্রাস করছে লবণাক্ততা। জমিতেও বাড়ছে লোনার আগ্রাসন। এ অবস্থায় দেশ ক্রমাগত বহুমুখী পানি সঙ্কটে নিপতিত হচ্ছে।
রাজশাহী থেকে রজাউল করিম রাজু জানান, তীব্র তাপাদহে পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে প্রকৃতি। এমন অবস্থায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ কুষকের কপালে। শুধু ধান নয়। প্রচন্ড খরায় আমের গুটি ঝরে পড়ছে। সেচ দিয়ে গুটিপড়া বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে পথে-ঘাটে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রুটি-রুজির তাগিদে আগুনমুখো আবহাওয়া উপেক্ষা করেই তাদেরকে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরাও নিদারুণ কষ্টে একেকটি উত্তপ্ত দিন পার করছে।
খরার প্রভাব শুধু কৃষিতে নয় পড়েছে মানবজীবনেও। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। রাজশাহীতে বইছে তাপপ্রবাহ। অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় জ্বর, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ডায়রিয়া ও নিমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেশী মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরইমধ্যে রোগীর চাপে রামেক হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডায়রিয়া রোগীর জন্য শয্যা সংখ্যা সংকুলান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কতৃপক্ষকে। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডের বাইরে মানুষের চলাচলরত রাস্তার মেঝেতে থাকছেন রোগীরা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংকট প্রকট হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দেড়শো ফুটের বেশী নীচে নেমে গেছে। হস্তচালিত নলকূপ পরিত্যাক্ত হয়েছে। বছর দশেক আগে এই অঞ্চলে ষাট সত্তর ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। এখন দেড়শো ফুটেও পানি পাওয়া যায়না। বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে গেছে। দেশে বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির পর পূন:ভরন হার ২৫ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র আট শতাংশ।
বৈশাখের শুরু থেকেই উত্তরাঞ্চব্যাপী যে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে ধানের জমিতে সেচে খরচ বেড়েছে দ্বিগুনের বেশি। সেচ দিয়ে পানি ক্ষেতে বেশি দিন থাকছে না। অল্প দিনেই শুকিয়ে মাটি চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এবং তীব্র খরায় পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয় তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবে পূরন হবার কথা। ব্যাপক পানি উত্তোলন ও বৃষ্টিহীনতা পানির সেই স্তর পূরন হচ্ছেনা। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী দূর্ভোগ বয়ে এনেছে প্রলম্বিত খরা। টানা বৃষ্টিহীনতা এমনকি শীত মওসুমেও কাংখিত বৃষ্টি না হওয়া। সবকিছু মিলিয়ে পানির শংকা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আব্দুল সালামের অভিমত রাজশাহী এমনিতে উষ্ণতম জেলা। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছেনা। ফলে খরা প্রলম্বিত হচ্ছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায় শনিবার মৌসুমের সব্বোর্চ তাপমাত্র রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার বেলা ৩টার দিকে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এই তীব্র গরমে জনজীবনে অস্থিরতা নেমে এসেছে। খরার উচ্চ ঝুকিতে রাজশাহীসহ উত্তরের ছয়জেলা। দেশের ২২ জেলা খরার ঝুকিতে থাকলেও খুবই উচ্চ ঝুকিতে রয়েছে ছয় জেলা। এগুলো হলো: রাজশাহী, নওগা, চাপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগা।
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ,নওগাঁ, দিনাজপুর ও বগুড়ার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্রভুমিসহ উত্তর জনপদজুড়েই এখন চলছে পানির জন্য হাহাকার। মাঘ ফাল্গুনে বার দু’য়েক বৃষ্টির পর দীর্ঘ খরায় পুড়ছে ফসলের মাঠ, নদ-নদী, খাল, বিল,পুকুর শুকিয়ে চৌচির, বাতাসে আগুনের হলকা। গরম বাতাসের তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে আম,কাঁঠাল, লিচু, জামের গুটি, পোক্ত হওয়ার আগেই সেগুলো অকালে পেকে শুকিয়ে ঝরে পড়ছে ঝরা বকুলের মত। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। স্কুল কলেজ সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রম্ভ্রপুত্র নদের চরগুলো যেন সাহারা মরুভুমির রুপ নিয়েছে। উত্তরের চরাঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় এককোটি মানুষ তাদের গবাদীপশু নিয়ে চরম অসহায় জীবন যাপন করছে।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য দপ্তর থেকে সদ্য পাওয়া তথ্যে জানা যায় , ৮০’র দশক থেকে বিভিন্ন জনপদে বসানো দুই লক্ষাধিক নলকুপ, তারা পাম্প এখন অকোজে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। কিছুকিছু নলকুপে কেবল বর্ষা মওশুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগের রংপুরের এসি আবুল কালাম আজাদ জানান, ৮০ দশকে রংপুর অঞ্চলে পাতকুয়া টাইপের জলাধার থেকেই চাষাবাদ এমনকি খাওয়ার সুপেয পানি পাওয়া যেত। এখন সেই পানিস্তর ১০০ ফিট নিচে নেমে গেছে।
বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয় সেচ প্রকল্প ( বিএমডিএফ) পানি সংক্রান্ত রিসার্চের তথ্যে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের উচ্চভূমিতেও পানির স্তর ৩৯ ফিটের মধ্যেই ছিল। ২০২৪ সালে এখন সেই পানিস্তর নেমে গেছে ১৫০ ফিটেরও নিচে। এই মুহুর্তে উত্তর জনপদের রাজশাহী, চাঁপাই, নওগাঁ, বগুড়া, দিনিাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর বাসিন্দারা চরম বিপাকে পড়ে রেশনিং করে পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে। সাবমর্সিবলের চাহিদা বেড়েছে শহরাঞ্চলে গ্রামের মানুষ সেচ স্কিমের মেশিনের পানি সংগ্রহ করে পানির চাহিদা মেটাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র কর্মি সৈয়দ ফজলে রাব্বির সুস্পস্ট অভিমত হল জরুরী ভিত্তিতে পদ্মা ও তিস্তাসহ ভারত থেকে ভাটিতে বাংলাদেশে বয়ে আসা নদনদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত না করলে বিরূপ আবহাওয়ার কারণেই বরোন্দ্রাঞ্চল তথা উত্তর জনপদ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হয়ে পড়বে। তিনি মনে করেন , ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর পানি বন্টন ইস্যু এখন আর দ্বিপাক্ষিকতার মধ্যে না রেখে এটাকে জাতিসংঘে উপস্থাপনার সময় এসেগেছে।
খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলেও খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা পাইকগাছাসহ বিভিন্ন উপজেলায় খাবার পানির তীব্র সঙ্কট চলছে। পানি সংগ্রহ করতে কয়েক মাইল হেঁটে যেতে হচ্ছে। পাইকগাছা উপজেলার শান্তা গ্রামের বাসিন্দা শাফায়েত হোসেন বলেন, তীব্র গরমে খাবার পানির পুকুরগুলোও শুকিয়ে গেছে। বাড়ির গৃহিণীসহ অন্য সদস্যরা কলস নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করেন। চারপাশে পানি থাকলেও খাবার উপযোগী পানি নেই কোথাও, সবই লবণাক্ত। খুলনার মতো বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় বিভিন্ন উপজেলায় এখন তীব্র পানি সঙ্কট চলছে। বাগেরহাটের উপকূলীয় মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় নলকূপ ও গভীর নলকূপ অকার্যকর হয়ে গেছে। নদী-খালের মতো নলকূপের পানিতে লবণাক্ততার কারণে লোকজন সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখেন খাবার জন্য। সেই পানি ফুরিয়ে গেছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে সুপেয় পানির হাহাকার চলছে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা; আর শুকনা মৌসুমে এক কলস পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ। বেশির ভাগ পরিবারে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব থাকে নারীর কাঁধে। জলাবায়ু পরিবর্তন, পানির প্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দিন দিন বাড়ছে উপকূলীয় এলাকার নদী ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ। বাড়ছে লবণাক্ত এলাকাও। আর তাতে এসব এলাকায় ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। এতে হুমকির মুখে পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তাসহ সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। ইনকিলাব