ডেস্ক রির্পোট:- পারিবারিক অশান্তি থেকে ছেলেকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন বাবা। একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মশিউর রহমান। তিন বছর আগে তার চাকরি চলে যায়। চাকরি হারানোর পর চার সদস্যের পরিবারে আর্থিক অনটন দেখা দেয়। এ নিয়ে পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। এই হতাশা থেকেই মশিউর রহমান ছেলে ও মেয়েকে শ্বাস রোধ করার পর নিজে রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। গত রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের তালতলা এলাকার একটি বাসা থেকে বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিন সন্ধ্যায় তালতলার মোল্লাপাড়া এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে মশিউর রহমান ও তার কলেজপড়ুয়া ছেলে সাহদাবের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মশিউরের মেয়ে সিনথিয়াকে। পরে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকেও শ্বাস রোধ করে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন মশিউর রহমান।
এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) ইমরান হোসেন বলেন, আর্থিক অনটন ও পারিবারিক হতাশা থেকেই ছেলে ও মেয়ের শ্বাস রোধ করে মশিউর রহমান। পরে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার ছেলে ঘটনাস্থলে মারা যান। আর মেয়েকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মেয়ের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। ঘটনার সময় মশিউরের স্ত্রী টিউশনি করতে বাইরে গিয়েছিলেন।
গত ৩রা এপ্রিল গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় মাদকাসক্ত ছেলেকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে বাবাকে আটক করেছে পুলিশ। এদিন সকালে উপজেলার জামালপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। এর আগে ভোরে একই এলাকায় ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে বাবা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় লোকজন। নিহত তরুণের নাম কাউসার বাগমার। তার বাবা কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর এলাকার বাসিন্দা রশিদ বাগমার। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিহতের বাবা গণমাধ্যমসহ পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ছেলেকে কুপিয়ে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পুলিশ জানায়, কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর এলাকার কাউসার বাগমার তিন বছর আগে প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর থেকে তিনি আর কোনো কাজ করতেন না। ধীরে ধীরে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন। বিভিন্ন সময় মাদক সেবনের টাকার জন্য বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করতেন। মা-বাবাকে মারধর এবং খারাপ আচরণ করতেন। তার অত্যাচারে মা-বাবাসহ স্বজনেরা অতিষ্ঠ ছিলেন। ঘটনার আগের দিন রাতের খাওয়া শেষে কাউসার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ধারালো কুড়াল দিয়ে ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেন রশিদ বাগমার।
এদিকে চলতি সপ্তাহে আবাসিক হোটেল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা সোহানুর রহমানের মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রোববার দুপুরে তিনি যাত্রাবাড়ীর ওই আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন। পুলিশ জানায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে সামিয়া রহমান সৃষ্টি নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমানের মেয়ে। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ক্যামব্রিয়ান স্কুলের পাশে রংধনু আবাসিক হোটেলের ২১০ নম্বর কক্ষ থেকে সন্ধ্যায় পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাব্বির হোসেন বলেন, হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রংধনু হোটেলের দ্বিতীয় তলার ২১০ নম্বর কক্ষ থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জানালার গ্রিলে বাঁধা ওড়নার সঙ্গে তার মরদেহ ঝুলছিল। তিনি জানান, সামিয়া রহমান উত্তরা ২ নম্বর রোডের ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় স্বামী তানিমের সঙ্গে বসবাস করতেন। পারিবারিক বিষয় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। ঘটনার দিন দুপুরে তিনি যাত্রাবাড়ীর ওই আবাসিক হোটেলে উঠলে সন্ধ্যায় হোটেল কর্তৃপক্ষ ইফতার নিয়ে দরজায় নক করে কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে থানায় খবর দেয়। পরে হোটেলের দরজা ভেঙে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
চলতি বছরের মার্চ মাসে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত বছর দেশে ৩ হাজার ২৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দিনে ৮টির বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৩৭টি। সে হিসাবে দিনে ৩০টির বেশি নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের খাতায়। গত তিন বছরে পুলিশ সদর দপ্তরের তৈরি করা সারা দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সারা দেশের থানাগুলোয় হওয়া মামলার ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ২৫ হাজার ৪৯টি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন বছরই দেশে গড়ে তিন হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। করোনাকালে বেশ কিছু নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটে, যেগুলোয় পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরাই জড়িত ছিলেন। স্ত্রী, সন্তান বা মা-বাবাসহ পরিবারের ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত হত্যার ঘটনা ঘটে। দেশে নারী নির্যাতনের চিত্রও ভয়াবহ। গত বছর ১১ হাজার ৩৭টি নারী নির্যাতনের মামলা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ২৫ হাজার ৪৯টি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায়। এ সময় বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ২৫ হাজার ৪৯টি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায়। গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের পুলিশ সুপার ইনামুল হক বলেন, অপরাধ বেড়েছে বা কমেছে এটা সরাসরি বলার সুযোগ নেই। কখনো অপরাধ বাড়ে, কখনো আবার অপরাধের মাত্রা কমে যায়। নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে সামাজিক বন্ধন দুর্বল হলে মানুষ অপরাধ ও খুনোখুনির মতো ঘটনায় যুক্ত হয়। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা হচ্ছে। অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, হত্যাকাণ্ড, খুনাখুনিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সবসময়ই ছিল। এর মাত্রাটা কখনো বাড়ে কখনো আবার কমে যায়। এক্ষেত্রে পুলিশকে তার পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। এতে করে কিছুটা হলেও সমাজে অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ হবে। অপরাধীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক থাকলে অপরাধ কমার তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। তাই এক্ষেত্রে পেশাদার এবং নৈতিক পুলিশের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এ ছাড়া পারিবারিক কলহসহ বিভিন্ন কারণে যে সকল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সেগুলো কিন্তু পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানী ড. নেহাল করিম বলেন, একজন বাবা কোন পর্যায়ে গেলে তার সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করেন। সে বিষয়টি আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে। ছেলে একদিনে মাদকাসক্ত হয়নি। এক্ষেত্রে বাবা-মাকেও তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখা উচিত ছিল। এ ছাড়া প্রায়শই আমরা গণমাধ্যমে দেখে থাকি অভাবের তাড়নায় মা তার শিশু সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিচ্ছে, বাবা- স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছেÑ এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। সমাজে শিক্ষার হারের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব বাড়ছে। সে হিসাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। পারিবারিকভাবে বোঝাপড়াটা আগের মতো স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। এ জন্য আমরা সকলেই কম বেশি দায়ী।মানবজমিন